ঘড়িতে ১২:৫০ বাজে। গত কয়েক ঘন্টায় মোট ৬ টা বাস এসেছে। এতক্ষণ কেবল অস্বস্তি হচ্ছিল। এবার রীতিমতো বিরক্ত লাগতে লাগল পাভেলের কাছে। ও এখনো ভাবছে কাজটা ঠিক হচ্ছে কিনা।
বর্তমানের প্রতিযোগিতাপূর্ণ পৃথিবীতে ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো কি আদৌ যুক্তিসঙ্গত। এখন শীতের সময় নয় তবুও এই শহরতলীর এক চিলতে বাসস্ট্যান্ডের বেঞ্চে বসে বেশ ঠাণ্ডা লাগছে ওর। রাস্তায় আপাতত ও ছাড়া আর কেউ নেই। এদিক-ওদিক এক দেড় মাইলের মধ্যে মোটে চারটা লাইটপোস্ট। ম্লান হলদে আলো ছড়াচ্ছে ওগুলো। কিন্তু এই নিকষ কালো অন্ধকারের বিরুদ্ধে এটে উঠছে না। কেবল মিটমিট করে জ্বলতে জ্বলতে নিজেদের অস্তিত্বটুকু বজায় রাখতে চেষ্টা করছে।
গায়ের বাদামী রঙের জ্যাকেটটার গলা পর্যন্ত জিপার টেনে দিল পাভেল। বিরক্তি কাটাতে বেঞ্চ থেকে উঠে খানিকক্ষণ পায়চারী করল ও। রাস্তার দুদিকে যতদূর দেখা যায় কেউ নেই। আশেপাশে প্রাণের অস্তিত্ব বলতে কেবল পাশের জঙ্গলের দিক থেকে ভেসে আসা জন্তু
জানোয়ারের ডাক। অথচ এই বনের ভিতরের পথ দিয়েই ফিরতে হবে। কি করবে বুঝতে পারছে না ও।
আবার গিয়ে বেঞ্চে বসল, পিঠ ঠেকিয়ে আরাম করে।
পাভেল সাউথ এশিয়ান। বর্তমানে তিনকুলে কেউ নেই। মা মারা গেছে ওর যখন দুই বছর বয়স। তাই ছোটবেলা থেকে গভর্নেসের কাছে মানুষ। ওর বাবা একজন পলেটিক্যাল লিডার।তাই তাকে সেরকম কাছে পেত না ও। সাধারণত এরকম পরিস্থিতিতে যেকোনো ছেলে স্পেশ্যলি পলেটিক্যাল লিডারদের ছেলেরা নানাভাবে কুপথে গিয়ে নস্ট হয়ে যায়। কিন্তু ওর ক্ষেত্রে তা ঘটেনি। আর এর পিছনে রয়েছে ওর একটা অভ্যাস। বই পড়া। সব ধরনের তথ্য এবং জ্ঞানের প্রতি টান আছে ওর। এজন্যই অন্য কোনও দিকে মন না দিয়ে কেবল প্রচুর বই পড়ত। তবে স্কুলের ধরাবাধা নিয়ম আর টেক্সটবুকের প্রতি কোনো আকর্ষণ ছিলনা। ক্লাস সেভেনে পড়ার সময় ওর বাবা মারা যান। আর ইন্সিডেন্টালি ঐ বছরেই ও একটা স্কলারশিপ পায়। তখন দেশের সবকিছু বিক্রি করে দিয়ে চলে আসে আমেরিকায়। নিয়্যু অরলিন্সের একটা জুনিয়র হাইস্কুলে ভর্তি হয়। তারপর টিন রিপোর্টার হিসেবে এক নিউজ অফিসে পার্ট টাইম জব নেয়। কাজের চেয়ে স্টাডি আর গবেষণা করার চান্স বেশি হওয়ায় জবটা ওর খুব পছন্দ। বেশ ভালোই চলছিল সবকিছু। এমন সময় ঘটে গেল একটা ঘটনা।
নভেম্বরের ছুটিতে অন্য সময়ের চেয়ে বেশি কাজ করছিল ও। এমনই একদিন এডিটর ওকে একটা ইভেন্ট কভার করতে বললেন। টিনএজার ছেলেমেয়েদের হ্যালোইন পার্টি। ইভেন্টটা পছন্দ না হলেও তর্ক করল না ও।
যথারীতি গেল ইভেন্ট কভার করতে। পার্টি মানে আর কি _ বড়লোক বাবাদের ছেলেমেয়েদের ছোটলোকি ব্যাপার-স্যাপার। অফিস্যলি যতটুকু টাইম দেয়া উচিত তারচেয়ে বেশি এক সেকেন্ডও দেরী করল না ও, বেরিয়ে এল। এসব পার্টি সম্পর্কে কিছু গথবাধা কমন লাইনস আছে যা প্রিন্ট করে দিলেই আর্টিক্যেল হয়ে যাবে। জাস্ট ফর্মালিটিজ, নাথিং টু অবজার্ভ।
বিল্ডিং থেকে বের হওয়ার একটু পরেই ওর কাছাকাছি ভারী কিছু পড়ার শব্দ হল। কাছে গিয়ে দেখল একটা ছেলে পড়ে আছে। চারিদিকে রক্ত ছড়ানো। ও তাড়াতাড়ি চেক করল, তখনও বেঁচে আছে। এরপর হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হল। ব্লাড গ্রুপ ম্যাচ হওয়ায় ইন্সট্যান্টলি পাভেলকেই রক্ত দিতে হল। পুলিশ এসে সবার স্টেটমেন্ট নিল। ইনভেস্টিগেশন শুরু করল।
হসপিটাল থেকে রাস্তায় বেরিয়ে এল পাভেল। চারিদিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ট্যাক্সি নিল। যত দ্রুত সম্ভব নিউজটা রেডি করে ফেলতে হবে।
ব্যাস্ত দুনিয়ার সাথে তাল মিলিয়ে চলতে চলতে এসব প্রায় ভুলে গেছিল পাভেল। কিন্তু ঐ ঘটনার প্রায় পনের দিন পর এক রাতে ওর ফোনে একটা আননৌওন নাম্বার থেকে কল আসল।
"আই ওয়ানা ট্যক টু রিপোর্টার পাভেল।" অচেনা কণ্ঠটা বলল।
"ইয়া। পাভেল স্পিকিং। হু ' র য়্যু ?"
"য়্যু ডোন্ট নৌ মি। আয়্যাম হেনরি। আয়্যাম ইন নিড টু হ্যাভ সাম ওয়্যর্ডস য়্যুইথ য়্যু।"
"অল রাইট। গো অন।"
"নো নট অন ফোন। " অস্থিরভাবে বলে উঠল কণ্ঠটা। "ইট ' স কিন্ডা আর্জেন্ট।"
"সো ?"
"মিট মি এ্যাট দ্য ফোর্থ পয়েন্ট অন দ্য স্নো হিল।"
"রাইট নাউ ! এ্যাট দিস লেট নাইট ?"ভীষণ অবাক হল পাভেল।
"প্লিজ ডোন্ট সে নো। আয়্যাম ইন আ ভেরি বিগ ডেঞ্জার। আয়্যাম ওয়েটিং।" অজ্ঞাত লোকটা ফোন কেটে দিল।
কনফিউজড হয়ে গেল পাভেল। কি করবে এখন?
কে এই হেনরি ? তার কিসের বিপদ ? পাভেলের কাছেই বা কি চায় ? আর এত রাতে স্নো হিলের মতো একটা নির্জন জায়গায় একা যাওয়াটাই বা কি ঠিক হবে ?
অনেকগুলো কি এবং কেন। তবে ডিসিশান নিয়ে নিল পাভেল। যাই হোক ও যাবে।
তবে প্রয়োজনীয় সতর্কতা অবলম্বন করতে ভুলল না। অফিসের ওয়েবসাইটে হেনরির কল এবং দেখা করতে যাওয়ার জায়গা উল্লেখ করে একটা প্যাসেস লিখে রাখল। এরপর অফিস থেকে দেয়া জিপিএস ট্রান্সমিটারটা শরীরে লুকিয়ে রাখল। পায়ের বুটের সাথে প্রিয় হান্টিং নাইফটা বেঁধে নিল। সবশেষে কোমরে গুজল একটা জার্মানি টুয়েলভ শট। লোড করে চেম্বারে একটা বুলেট তুলে ম্যাগজিন রিফিল করে নিয়েছে।
এত সতর্কতার প্রয়োজন রয়েছে। প্রথমত ও দেখা করতে যাচ্ছে একদম অপরিচিত একজনের সাথে। তাও একটা খুব নির্জন জায়গায়। হাজার হোক এটা ইয়াঙ্কিদের দেশ, রিপোর্টারদের তো আর বিপদের ঠিক নেই।
আবহাওয়া ভালো নয়। ঝড়বৃষ্টির আগাম ইঙ্গিত।
জোর বাতাস বইছে, ঘনঘন বিদ্যুত চমকাচ্ছে।
এরমধ্যে দিয়েই পাতলা, ঘন জঙ্গল আর উচুনিচু পাহাড়ি ঢাল পেরিয়ে এগিয়ে চলল পাভেলের কালো রঙের টু-সিটার মিনি অস্টিন। অফিসের গাড়ি এটা। সব ধরনের রাস্তায় স্বচ্ছন্দে চলতে পারে। রিপোর্টারদের জন্য আদর্শ বাহন।
ফোর্থ পয়েন্টে এসে গাড়ি থেকে নামল ও। তবে গাড়ির ইঞ্জিন অফ করল না। দরজাও লক করল না। এরপর সবদিকে নজর রেখে এগুতে লাগল। এমন সময় হটাৎ যেন আঁধার ফুড়ে বেরিয়ে এল একজন। লম্বা আর ছিপছিপে গড়নের একটা আমেরিকান ছেলে। পাভেলের থেকে বছর দুয়েকের বড় হবে। আগাগোড়া খুঁটিয়ে দেখল পাভেল। ছেলেটার মধ্যে কেমন যেন অস্বাভাবিকতা টের পেল ও। ফ্যাকাশে ভাবলেশহীন মুখ, সবচেয়ে অদ্ভুত হচ্ছে চোখজোড়া। অন্ধকারে জ্বলজ্বল করছে, বিদ্যুতের চমকে ঝিকিয়ে উঠছে _ অনেকটা বিড়ালের মত।
হেনরির সাথে কথা বলে অনেক রাতে বাসায় ফিরল পাভেল।
সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে ভাবতে লাগল পুরো বিষয়টা। হেনরির কথার সারমর্ম হচ্ছে _ নিয়্যু অরলিন্স থেকে বেশ দূরে লিটল রকের একটা ছোট ও অনুন্নত শহরতলীতে তার বাড়ি। তার বাবা ছিল একটা লোকাল চার্চের প্রিস্ট। তারা তিন ভাইবোন। হেনরি, হ্যারি এবং সবার ছোট জেসিকা। ওরা ছোট থাকতেই ওদের বাবা মারা যায়। এই পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে ওদের প্রতিবেশী হম্যান কার্ল ওর মাকে বিয়ে করে। লোকটা খুবই খারাপ এবং লোভী। ওদের বাড়ি এবং জমি দখল করে নিজের সম্পত্তির সাথে মিলিয়ে একটা স্টেট বানানোই ছিল তার মুল লক্ষ্য। তবে হেনরিদের সম্পত্তি ওদের সবার নামে বন্টন করা থাকায় হম্যানের ইচ্ছা পূর্ণ হয়নি।
তাকে অপেক্ষা করতে হয় ওদের সবার প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে ওঠা পর্যন্ত। এসময় লোকটার সাথে থাকতে না পেরে হেনরি বাড়ি ছেড়ে চলে যায়। কিন্তু গোপনে নজর রাখে যাতে তার পরিবারের ক্ষতি করতে না পারে লোকটা। এর কয়েক বছর পর জেসিকা লস এ্যাঞ্জেল্সে গিয়ে হোস্টেলে থাকতে শুরু করে। বাড়িতে কেবল মা আর হ্যারি। হ্যারি হম্যানকে সন্দেহ করতে শুরু করে যে সে কোনো ইল্লিগাল কাজের সাথে জড়িত। একসময় সে হম্যানের বিরুদ্ধে প্রমাণ জোগাড় করে ফেলে। কিন্তু হম্যান তা জেনে যায়। হ্যারি বাড়ি থেকে পালিয়ে নিয়্যু অরলিন্সে চলে আসে। কিন্তু এক হ্যালোইন পার্টিতে হম্যানের সাথে দেখা হয়ে যায় তার। দুজনের মধ্যে ধস্তাধস্তি হয়। হ্যারিকে দোতলা থেকে ফেলে দেয় হম্যান। পাভেল হ্যারিকে হসপিটালে নিয়ে যায়।
সাময়িকভাবে প্যারালাইজড হয়ে যায় হ্যারি। তখন স্টেপফাদারের পরিচয় দিয়ে হম্যান তাকে ডিসচার্জ করে আনে এবং খুন করে লাশ গুম করে ফেলে। একই কাজ করে তার মায়ের সাথেও। টাউন শেরিফও তার লোক। তাই পুরো ব্যাপারটাই ধামাচাপা দেয়া সম্ভব হয়।
এখন হেনরি চায় যে পাভেল সেখানে যাক এবং হ্যারির জোগাড় করা প্রমাণ খুঁজে বের করুক। হেনরি তাকে সবধরণের সাহায্য করবে। কিন্তু সে কারো সামনে আসবে না।
পাভেল পুরো ব্যাপারটা বারবার ভেবে দেখল। হেনরি যে পুরোপুরি সত্যি বলছেনা তা ও বুঝতে পারছে। কারণ হেনরি যদি বাড়ি ছেড়ে থাকে তাহলে এই পুরো ব্যাপারটা এতো নিখুঁতভাবে তার জানার কথা নয়। স্পেশলি হ্যারি আর হম্যানের সম্পূর্ণ পার্সোনাল এবং গোপনীয় কাজগুলো সে কিভাবে জানলো ? আর সবচেয়ে আশ্চর্য ব্যাপার হচ্ছে একজন মানুষ যে এটা জানে যে তার মা এবং ভাইকে খুন করা হয়েছে সে কিভাবে এরকম নিস্ক্রিয় থাকতে পারে ?
এবার দেখা যাক পাভেলের নিজের কি লাভ হবে ? হ্যা লাভ হবে। কারণ ঘটনাটা যদি সত্যি হয় তাহলে চমৎকার একটা স্টোরি হবে আর যেহেতু হেনরি অন্তরালে থাকবে তাই এই কেস সলভ করার ক্রেডিটটা ওই পাচ্ছে। কাজেই হেনরিকে হেল্প করা যেতেই পারে। বাট এই হেনরি ক্যারেক্টারটা বেশ মিস্টিরিয়াস। সে কতটুকু বিশ্বাসযোগ্য ?
পরদিন পাভেল পুরো প্রস্তুতি নিল শহরতলীতে যাওয়ার জন্য। রওনা দেয়ার আগে রাতে সেই একই জায়গায় গিয়ে হেনরির সাথে আর একবার দেখা করবে। হেনরির এই রাতে নির্জন জায়গায় দেখা করার অভ্যাসটাও বেশ মিস্টিরিয়াস।
এইরাতে হেনরি পাভেলকে বলল শহরতলীতে গিয়ে সে হেনরির ইন্স্ট্রাকশন অনুযায়ী একটা একতলা বাড়ি খুঁজে বের করে সেখানে থাকবে। বাড়ির চাবি দিয়ে সে আরো বলল কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে পাভেল যেন নিজেকে হ্যারির বন্ধু বলে পরিচয় দেয়। এবং কারও সাথে যেন হেনরির সম্পর্কে কথা না বলে। __ শেষের এই বাক্যে অনাবশ্যক জোর দিল হেনরি।
এবারে হেনরির মধ্যে আরও বেশি অস্বাভাবিকতা লক্ষ্য করল পাভেল। তার শরীর থেকে কেমন যেন তীক্ষ্ণ এক মেডিসিনের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছিল। আরও অদ্ভুত হচ্ছে যে হ্যান্ডশেক করার সময় পাভেল দেখল হেনরির হাত বরফের মত ঠান্ডা আর শক্ত। এমনকি দীর্ঘক্ষণ সেই হাতে কোনো পাল্সও টের পেল না পাভেল।
শহরতলীতে এসে হেনরির কথামত একতলা বাড়িটা খুঁজে বের করল পাভেল ম বেশ পুরনো কিন্তু পরিষ্কার--পরিচ্ছন্ন বাড়িটা।
বেশকিছু পুরনো ফার্নিচারও আছে। তবে পুরো এলাকাটা কেমন যেন অস্বাভাবিক রকম চুপচাপ।
নিজের রান্না নিজে করতেই অভ্যস্ত ও। তাই খাবারের সমস্যা হলো না।
হেনরিদের বাড়ির কাছাকাছি একটা টিলা আছে। সেখান থেকে বাড়ির উপর নজর রাখতে শুরু করল ও। বাড়িতে থাকে কেবল দুজন। হম্যান আর একজন কাজের মহিলা। তবে একটা লরি আসে প্রতিদিন।
হম্যান মাঝারি উচ্চতার লিকলিকে একটা লোক। মাথাভর্তি টাক, পাখির ঠোঁটের মত লম্বা নাকের নিচে বেমানান সাইজের বড়বড় গোঁফ। আর সবসময় ধোপদুরস্ত পোশাক পরে ফুলবাবু সেজে থাকে। দূর থেকে দেখলেও পাভেল বুঝতে পারল এর মেজাজ সবসময়ই তিরিক্ষি।
এছাড়া আরও একটা ব্যাপারে ও নিশ্চিত হলো যে হ্যারির সন্দেহ সঠিক ছিল। কারণ লরিটা নিয়ে যারা আসে তাদের মধ্যে একজনকে চিনতে পারল ও। লোকটার নাম রবার্ট, দাগী আসামি।
জানলা খুলে দিল পাভেল। রাতের ঠান্ডা বাতাস আসতে লাগল। অন্ধকারে বনের অস্পষ্ট অবয়ব দেখা যাচ্ছে। পুরো বনটাই যেন একটা জমাট বাঁধা অন্ধকার। তার উপরে ছোট্ট একফালি চাঁদ আর অগণিত তারা। মাঝেমাঝেই বনের ভিতর থেকে কয়োট আর নেকড়ের ডাক শোনা যাচ্ছে। জানলার সামনে এমন একটা পরিবেশের মধ্যে দাঁড়িয়ে রইল পাভেল। ভেজা ভেজা বাতাস এক অদ্ভুত আবেশ তৈরি করল ওর শরীরে। কেমন একটা শিরশিরে অনুভুতি।
বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে গা ঝাড়া দিল ও। একমগ ধূমায়িত কফি নিয়ে ডেস্কে বসল। এই পর্যন্ত যা যা দেখেছে, জানতে পেরেছে বা ধারণা করেছে - সবকিছু মাথায় রেখে রিপোর্ট তৈরি করতে হবে। তারপর ঢুকতে হবে হেনরিদের বাড়িতে, খুঁজে বের করতে হবে হ্যারির যোগাড় করা প্রমাণ।
এমন সময় হেনরি ফোন করল।
"হ্যালো হেনরি, হোয়াট'স আপ ?"
"দেয়ার'জ আ প্রব্লেম।"
"জেসিকা শহরতলীতে আসতে চাইছে।"
"সো হোয়াট'স দ্য প্রব্লেম ?"
"হোয়াই ডোন্ট য়্যু আন্ডাস্ট্যান্ড ? হম্যান আমাদের সম্পত্তি দখল করতে চায়। মা আর হ্যারিকে খুন করেছে। আমি তো থেকেও নেই। কাজেই এখন একমাত্র ওয়ারিশ হচ্ছে জেসিকা। তাকে কি হম্যান ইজিলি ছেড়ে দেবে।"
"ওয়্যেল। আই গট ইট। বাট এক্ষেত্রে আমার কিছু করা মানে তো সম্পূর্ণ তোমাদের পারিবারিক ব্যাপারে ইন্টার্ফেয়ার করা।"
"সো দ্যাট য়্যু' ল লেট হার বি কিলড ?"
"নো আই ডোন্ট মিন দ্যাট। আমি বলছিলাম যে তুমি অন্ততপক্ষে তোমার বোনের সাথে তো দেখা করতেই পারো।"
" নো আই কান্ট।" চিৎকার করে উঠল হেনরি। "য়্যু গট ইট ? আই কান্ট। য়্যু মাস্ট মেক হার সেফ। এ্যান্ড য়্যু' ল ডু ইট।"
বিস্ময়ের চুড়ান্ত সীমায় পৌঁছে গেল পাভেল। হেনরি কোন অধিকারে তার উপর জোর খাটাচ্ছে?
আর ও নিজেই বা কেনো তা মেনে নিচ্ছে ? আশ্চর্য
ওর মনে হচ্ছে ওকে যেন অন্য কেউ কন্ট্রোল করছে।
যাইহোক অনেক চেষ্টা করে ও জেসিকার সাথে
কন্টাক্ট করল। তাকে পুরো ব্যাপারটা সংক্ষেপে জানালো। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে মিথ্যা বলতে হল। যেমন হেনরির ব্যাপারটা পুরো চেপে যেতে হল। পাভেল বলল হ্যারি তাকে এসব বলেছে আর
হম্যানের মুখোশ খুলে দিতে রিক্যুয়েস্ট করেছে, যখন ও হ্যারিকে হসপিটালে এ্যাডমিট করেছিল।
জেসিকা জানাল সে পরের রাতে আসবে এবং হম্যানকে উপযুক্ত শাস্তি দিতে পাভেলকে হেল্প করবে।
এই রুটের শেষ বাসটা এসে থামল। এগিয়ে গেল পাভেল। দেখল বাস থেকে ওর বয়সী একটি মেয়ে নামল। জেসিকাকে দেখেই ও চিনতে পারল।
কারণ হেনরির সাথে চেহারায় অনেক মিল। তার মতোই লম্বা আর ছিপছিপে গড়ন, চুলের রঙ হাল্কা লালচে। তবে হেনরির চোখের রঙ নীল আর
জেসিকার সবুজ।
"হাই। য়্যু মাস্ট বি পাভেল ?"
"ইয়া।"
"সরি। তুমি নিশ্চয়ই অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছ ?"
মাথা ঝাকিয়ে হাঁটতে শুরু করল পাভেল। ওকে অনুসরণ করল জেসিকা।
জঙ্গলের রাস্তার মোড়ে গাড়ি রেখেছিল পাভেল। রেন্টাল কার। পুরনো মডেলের জাপানি হোন্ডা। জিপের মতোই ফোর হুইল ড্রাইভ। সেল্ফসিলিঙ টায়ার হওয়ায় লিক হওয়ার সম্ভাবনা নেই। পুরু ইস্পাতের শিটে তৈরি গাড়িটা খুবই মজবুত।
দুজন গাড়িতে চড়ে বসল। পাভেল সামনে তাকিয়ে একমনে ড্রাইভ করছিল। হঠাৎ পেছনের একটা চাকা আটকে গেল একটা গর্তে।
এ্যাক্সিলারেটরে চাপ বাড়িয়ে দিল পাভেল। কিন্তু
কোনো লাভ হলো না। এমনিতেই জঙ্গলের মধ্যের মাটির রাস্তা, তার উপর কাঁদা হওয়ায় টায়ার ঠিকমতো কামড় বসাতে পারছে না।
জেসিকাকে ড্রাইভিঙ সিটে বসতে বলে নেমে এল পাভেল। গাড়ির পেছনে কাঁধ লাগিয়ে গায়ের জোরে ধাক্কা দিল। ধাক্কা আর ইঞ্জিনের শক্তি মিলিয়ে চাকাটা তুলতে পারল। এমন সময় কানে এল জেসিকার তীক্ষ্ণ চিৎকার।
এগিয়ে গিয়ে ও দেখতে পেল কালো পোশাক আর হেলমেট পরা একটা লোক দাঁড়িয়ে আছে। তার হাতে রিভলবার আর টার্গেট জেসিকা। ঝট করে কোমরে হাত দিল পাভেল। কিন্তু ওর টুয়েলভ
শটটা গাড়ির মধ্যে রয়ে গেছে।
কিংকর্তব্যবিমূড় হয়ে গেল পাভেল। এমন সময় একটা হিংস্র গর্জন শোনা গেল। হঠৎ কোথা থেকে যেন ছুটে এল একটা বিরাট বুনো নেকড়ে। লোকটাকে কামড়ে ধরে আবার মুহুর্তেই জঙ্গলের
মধ্যে মিলিয়ে গেল। হতবাক পাভেল দেখতে পেল
নেকড়েটার একজোড়া অস্বাভাবিক জ্বলজ্বলে চোখ।
ঘটনার আকস্মিকতায় অসাড় হয়ে গেছিল পাভেল। এই আক্রমণকারী কে ? নেকড়েটাই বা কোথা থেকে আসল ? আর জেসিকার আসার কথাই বা জানাজানি হলো কিভাবে ?
জেসিকার কথা মনে পড়তেই তার দিকে এগিয়ে গেল ও। ভয়ে তার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। চোখদুটো অস্বাভাবিকভাবে ঘোলাটে হয়ে গেছে, থরথর করে কাঁপছে সে । ওকে ধাতস্থ হতে সময় দিল পাভেল।
তুমি যে আজ এখানে আসছো তা হম্যান জানলো কিভাবে ? প্রশ্ন করল পাভেল।
গতকাল সব কথা জানতে পেরে রাগের মাথায় আমি হম্যানকে ফোন করেছিলাম। আর আমি আসছি একথা বলেছিলাম। কৈফিয়ত দিলো জেসিকা।
ও মাই গুডনেস ! ভীষণ রাগ লাগল পাভেলের। তোমার মাথায় সামান্য পরিমাণ বুদ্ধি থাকলেও বোধহয় এমন একটা বোকামি করতে না।
জেসিকার বোকামির জন্য তার নিজের সিকিউরিটি নষ্ট হলো। সেইসাথে পাভেলেরও কাজ বাড়ল। মানুষ কিভাবে এতটা বেওকুফ হতে পারে পাভেলের মাথায় আসল না।
জেসিকাকে নিয়ে বাড়ি আসার সাথে সাথেই হেনরি ফোন করল। জেসিকার থেকে আড়ালে এসে রিসিভ করল ও।
হেনরি এক্ষুণি দেখা করতে চায়। তাই পাভেলকে জঙ্গলের মধ্যে যেতে বলল।
পাভেল জঙ্গলের মধ্যে ঢোকার সাথে সাথেই যেন মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে এল হেনরি। দুহাতে শক্ত
করে ওর জ্যাকেটের কলার চেপে ধরল। হাউ দ্য হেল ক্যান য়্যু বি সো ইলরেস্পন্সিবল ? হি ওয়াজ এ্যাবাউট টু কিল জেসিকা !
গায়ের জোরে হেনরিকে ধাক্কা দিয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল পাভেল। লিসেন টু মি কেয়ারফুলি মি. হেনরি, আমি তোমার বাবার রাখা চাকর কিংবা তোমার বোনের বডিগার্ড নই। আমি তো কেবল তোমাকে হেল্প করতে এসেছিলাম। বাট তোমার ভাবসাবে তো অন্নকিছু মনে হচ্ছে। আমি কাল সকালেই এখান থেকে চলে যাবো। তুমি, তোমার মাথামোটা বোন, তোমার চাচাতো বাবাসহ তোমার চৌদ্দগুষ্ঠি জাহান্নামে যাও। আই ডোন্ট কেয়ার। ঝটকা দিয়ে ঘুম দাঁড়াল পাভেল। আচমকা ওর হাতের কব্জি চেপে ধরল হেনরি।
পাভেল মোটেও ভীতু বা দূর্বল নয়। বরং একরোখা আর জেদি। কিন্তু হেনরির লোহার মতো
বরফ শীতল হাতের ছোঁয়ায় ওর গায়ে কাঁটা দিয়ে
উঠল। পাভেলের শরীর রীতিমতো পেশিবহুল। অথচ এই রোগা হেনরির হাতের চাপে মনে হচ্ছে যেন ওর কব্জিটা গুড়িয়ে যাবে।
আমার কাজ শেষ না করে তুমি কোথাও যেতে পারবে না। ধীরে ধীরে উচ্চারণ করল হেনরি। তার কণ্ঠস্বর কাঁপন ধরাল পাভেলের বুকে। ও লক্ষ্য করল কথা বলার সময় ঝিকিয়ে উঠল হেনরির অস্বাভাবিক ঝকঝকে দাঁত।
সম্মোহিতের মতো বাড়িতে ফিরে আসল পাভেল। জেসিকা জিজ্ঞেস করল সে কোথায় গিয়েছিল। জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে একটা দায়সাড়া জবাব দিল ও। তারপর নিজের রুমে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিল। মাথার মধ্যে অসংখ্য প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। কে এই মিস্টিরিয়াস হেনরি, যে কারো সামনে এমনকি নিজের বোনের সামনেও আসে না ? পাভেলকে কেনো এরমধ্যে জড়ানো হলো ? জঙ্গলের মধ্যে সেই নেকড়েটা হঠাৎ কোথা থেকে আসল ? হেনরিই বা জানল কি
করে যে জেসিকার উপর এ্যাটাক করা হয়েছে ? আর ও নিজেই বা কেনো হেনরির জোড়াজুড়ি সহ্য
করছে ? কারণ কি ?
পরদিন সকালে হেনরিদের বাড়িতে মুখোমুখি হলো হম্যান আর জেসিকা।
হম্যানকে এই প্রথম কাছ থেকে দেখল পাভেল। বদমাশ, অপরাধী, ভন্ড, খুনি সবই এর ক্ষেত্রে খাটে। তার চেহারা দেখে মনে হলো খুব কষ্ট করে জেসিকার প্রতি আক্রোশ চাপা দিয়ে রেখেছে। আর ভালো মানুষি দেখাচ্ছে।
"কেমন আছো ?"
"তা দিয়ে তোমার কি দরকার, শয়তান কোথাকার ?" গলা চড়ালো জেসিকা। "তুমি আমার মা আর ভাইকে খুন করেছ। এইমুহূর্তে এখান থেকে দূর হও।"
"এসব তুমি কি আবোলতাবোল বলছ ?" রেগে লাল হয়ে গেছে হম্যান।
"আমি কি বলছি তা বুঝতে পারছো না তাই না ? বুঝবে যখন হ্যারির প্রমাণগুলো খুঁজে বের করে তোমাকে জেলে পাঠাবো তখন সবই বুঝবে।"
"ও তাহলে সবই জানো দেখছি, বদমাশ মেয়ে।তবে এটা তোমার জন্য ভালো হলো না। তোমার অবস্থাও তোমার মা আর ভাইয়ের মতো হবে।"
"এই মুহূর্তে আমার বাবার বাড়ি থেকে বের হয়ে যাও।" আবারও চেঁচিয়ে বলল জেসিকা।
"যদি না যাই ?"
"তাহলে তোমাকে ঝাড়ুপেটা করে বের করবো।"
পাভেলকে অবাক করে দিয়ে সত্যি সত্যি বেরিয়ে গেল হম্যান। এতক্ষণ পাভেল কোনো কথা বলেনি। এদের পারিবারিক ব্যাপারে নাক গলাতে চায় না সে। তবে জেসিকা আরও একবার চূড়ান্ত পর্যায়ের বোকামির পরিচয় দিল, হম্যাঙ্কে সব বলে দিয়ে।
কাজের মহিলা নোরাকে খাবারের ব্যাবস্থা করতে বলল জেসিকা। তারপর ওরা দুজন গেল হ্যারির রুমে।
পাভেলের ধারণা প্রমাণ এই বাড়িতেই আছে। কারণ অন্য কোথাও থাকলে হেনরি নিজেই তা খুঁজে বের করতো। বাড়িতে থাকায় হম্যানের হাতে পড়ার সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু হম্যানের কথাবার্তা থেকে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে সে পায়নি। তারমানে প্রমাণ এই বাড়িতেই আছে।
রুমে তেমন কোনো ফার্নিচার নেই। একটা সিঙ্গেল খাট, একটা আলমারি, একটা বুকশেলফ, একটা ডেস্ক আর দুটি চেয়ার।
পাভেল আলমারি আর ডেস্কের ড্রয়ারগুলো খুঁজলো, বিছানা উল্টেপাল্টে দেখল, চেয়ারদুটোর খাজগুলো পরীক্ষা করল। যতভাবে সম্ভব চেষ্টা করল। কিন্তু কোনো লাভ হলো না। অনেকটা অন্ধকারে হাতড়ানোর মতো। কারণ আসলে কি খুঁজছে তাই তো জানা নেই।
এবার বুকশেলফটার দিকে চাইল। রোমান, গ্রিক, ক্যাথলিক মাইথোলজিকাল বই দিয়ে বোঝাই করা হয়েছে।
"ধর্মের দিকে বেশ ঝোঁক ছিল মনে হয় হ্যারির?" প্রশ্ন করল পাভেল।
"নিশ্চই। কেনো তুমি এটা জানতে না ?" বেশ অবাক হলো জেসিকা।
"না। আ... আসলে হ্যারি কখনো এই ব্যাপারে আমাকে কিছু বলেনি।"
"হ্যারি বাবার মতো একজন প্রিস্ট হতে চাইত।"
"আই সি। ওয়্যেল তুমি তাহলে এই বইগুলো একটু খুঁজে দেখ।"
"কেন ? তুমি খুঁজবে না ?"
"না একটু সমস্যা আছে। আমি ওগুলো ধরবো না।"
"ওকে। তাহলে আমিই খুঁজছি।"
শেলফের সবগুলো বইই ভালোভাবে খোঁজা হলো।
কিন্তু কিছুই পাওয়া গেল না। আবারও হতাশ হলো
ওরা দুজন।
"আচ্ছা তোমাদের কোনো সিক্রেট হাইড আউট নেই ?"
"মানে ?"
"মানে ছোটবেলায় ভাইবোনেরা লুকোচুরি খেলতে, কিছু লুকিয়ে রাখতে। আছে এমন কোনো
জায়গা ?"
জেসিকা চোখ বন্ধ করে কিছু ভাবার চেষ্টা করল। কিছুক্ষণ পরেই জ্বলজ্বলে চোখে তাকালো। "ইয়া" চিৎকার করে উঠলো সে।
বেশ বড় একটা পাহাড়ি হ্রদ। পাড়ে ছোট্ট একটা কেবিন। আসলে একটা কুঁড়েঘর। তারই একটা থামের গায়ে হাত বুলালো জেসিকা। কট করে থামের গায়ে একটা ফাঁপা অংশ খুলে গেল। সেখান থেকে একটা মাঝারি সাইজের বক্স বের করে আনলো জেসিকা। গিফ্ট পেপারে মোড়ানো। কিন্তু দেখে বোঝা যাচ্ছে বেশ পুরনো।
"প্রতি বছর ক্রিসমাসে এখানেই আমার জন্য গিফ্ট লুকিয়ে রাখত হ্যারি।" নিচুস্বরে বলল জেসিকা।
পাভেল বক্সটা খুলল। ভেতরে একটা জুয়েল্যরি বক্স আর একটা চিঠি। কিন্তু সেটার ভাঁজ খুলতেই ভ্রু কুঁচকে গেল ওর। জেসিকার দিকে বাড়িয়ে দিল। "এটা কোন ভাষা ?"
"হিব্রু। আমরা বাবার কাছে থেকে শিখেছিলাম।" জবাব দিল জেসিকা।
জেসিকা চিঠিটা পড়ে শোনাল পাভেলকে। সেটা এরকম __
প্রিয় জেসিকা,
এটাই বোধহয় তোর জন্য আমার রাখা শেষ ক্রিসমাস বক্স। হম্যান একটা শয়তান। মাকে মেরেছে। আমাকেও মারবে। ওর থেকে দূরে থাকবি। ভয় পাবিনা। মাথা ঠান্ডা রেখে চিন্তা কর। বিদায়ী ঘন্টার মধ্যেই রয়েছে ওর শাস্তির উপায়।
মন খারাপ করিস না। ঈশ্বর তোর মঙ্গল করবেন। বেঁচে না থাকলেও তোকে চোখে চোখে রাখব।
তোর ভাই
হ্যারি
চিঠিটা পড়তে পড়তে জেসিকার চোখদুটো আপনা আপনিই ঝাপসা হয়ে এল। হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখ মুছল সে।
পাভেলের সেদিকে কোনো নজর নেই। সে দূর দিগন্তের দিকে চেয়ে আছে। চিঠিটায় স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয়া আছে। "এবার শুধু বিদায়ী ঘন্টাটা খুঁজে বের করতে পারলেই গেম ওভার।" নিজের হাতে কিল মেরে বলল পাভেল।
অদ্ভুত শ্লেষমিশ্রিত দৃষ্টিতে ওর দিকে চাইল জেসিকা। বোধহয় একটু সমবেদনা আশা করেছিল। কিন্তু পাভেল সেসবের ধারের কাছ দিয়েও গেল না। বরং বেরসিকের মতো জিজ্ঞেস করল, "এই বিদায়ী ঘন্টা সম্পর্কে তোমার কোনো আইডিয়া আছে ?"
" না।" অস্ফুটস্বরে উত্তর দিল জেসিকা।
" আমি শিয়্যোর যে এটা বুঝতে পারলেই টাস্ক কম্প্লিট।" নিজের কপালে একবার আঙুল দিয়ে টোকা দিল পাভেল। "মাই লাভলি ব্রেইন ব্রেক দ্য স্ল্যাং আপ।"
দুপুরে সেই একতলা বাড়িতে ফিরে গেল ওরা। দুজনের মধ্যে তেমন কথা হলো না। জেসিকার মন খারাপ। আর পাভেল চিন্তায় মগ্ন। রহস্যের কিনারায় এসে গেছে বলে সে খুবই উত্তেজিত।
লাঞ্চের ঘন্টাখানেক পর জেসিকা বলল, সে তার বাবার কবরে প্রার্থনা করতে যাবে।
একরকম বিরক্ত হয়েই সাথে যেতে চাইল পাভেল। কিন্তু জেসিকা বলল সে একাই যাবে।
মাত্র আর একবার বলে ওকে একাই যেতে দিল পাভেল। তার এত ঠেকা কিসের ? যাচ্ছে যাক, এখন দিনের বেলা। তেমন কোনো বিপদ হবে বলে মনে হয় না।
দুপুরের পর বিকেল গড়িয়ে যখন সন্ধ্যা নেমে আসল তখনও জেসিকা ফিরে আসল না। এবার পাভেল একটু চিন্তিত হলো। জেসিকাকে খুঁজতে বের হলো ও। সেমিটরিতে গিয়ে পেল না। তারপর ভাবলো বাড়ি যায়নি তো ? কিন্তু বাড়িতে গিয়ে নোরাকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলো, জেসিকা সেখানে যায় নি। এমনকি হম্যানেরও পাত্তা নেই। ব্যাপারটা ভালো ঠেকলো না ওর। হঠাৎ মনে হলো,
সেমিটরিতে কিছু মিস করেনি তো ? আবার ফিরে গেল সেখানে।
দেখা গেল ওর এবারের ধারণাই ঠিক। এক জায়গায় নরম মাটির উপর ধস্তাধস্তির চিহ্ন স্পষ্ট। জেসিকার একটা ইয়ার রিং কুড়িয়ে পাওয়ার প্র ব্যাপারটা পুরো স্পষ্ট হয়ে গেল। সেমিটরির বাইরে কাঁচা রাস্তায় একটা ট্রাকের টায়ারের ছাপ দেখতে পেল। এঁকেবেকে জঙ্গলের মধ্যের ট্রেইল ধরে চলে গেছে ট্রাকটা।
টায়ারের দাগ ফলো করে এগুতে লাগল ও। সন্ধ্যা পার হয়ে গেছে। বেশ টেনশন হতে লাগল। এমন সময় কে যেন ওর মাথার পিছনে ভারী কিছু দিয়ে আঘাত করল। চোখের সামনে পুরো পৃথিবীটা দুলে উঠল।
জ্ঞান ফেরার পর উঠে বসার চেষ্টা করল পাভেল। কিন্তু হাত-পা বাঁধা থাকায় পারল না। চারিদিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিল। নোংরা একটা ঘরের ফ্লোরে পড়ে আছে। অন্ধকারে তেমন কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। একটা খোলা জানালা দিয়ে খানিকটা চাঁদের আলো আসছে। ওর থেকে একটু দূরে দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে আছে জেসিকা। হাত-পা বাঁধা। চাঁদের আলোয় ওর দুইগাল চকচক করছে। বোধহয় চোখের পানির জন্য।
মাথার পিছনের দিকটা দপদপ করছে পাভেলের। তাই ইচ্ছে করেই কোনো কথা বলল না ও। চুপচাপ শুয়ে রইল। জানে টানাটানি করে বাঁধন খুলতে পারবে না। হঠাৎ জেসিকা অস্ফুটভাবে গুঙিয়ে উঠল।
" কি হয়েছে ?"
"তোমার হাতের কাছে.... " জেসিকার কথা শেষ হলো না।
পাভেল দেখল ওর হাতের কাছে ইঁদুর। কিন্তু ও ওটাকে তাড়াল না। কারণ ও লক্ষ্য করল ইঁদুরটার চোখদুটো অস্বাভাবিক রকম জ্বলজ্বলে। ঠিক সেই নেকড়েটার মতো। ইঁদুরটা একবার তার জ্বলজ্বলে চোখ নিয়ে ওর দিকে চাইল। চমকে উঠল পাভেল। কারণ ইঁদুরটার চেহারায় যেন স্পষ্ট তিরস্কারের চিহ্ন ফুটে উঠেছে। ইঁদুরটা ওর হাতের বাঁধনটা কেটে দিয়ে চলে গেল।
বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে নিজের পায়ের বাঁধন খুলে নিল ও। তারপর জেসিকার বাঁধন খুলল।
"এখন আমরা কি করব ?" প্রশ্ন করল জেসিকা।
"এখান থেকে বেরোতে হবে। "
" কিভাবে ?"
জবাব না দিয়ে পকেটে হাত দিল পাভেল।
"যা ভেবেছিলাম তাই টাকাপয়সা, গাড়ির চাবি, এমনকি রিভলবারটা পর্যন্ত নিয়ে গেছে।"
" তাহলে ?"
" ওয়েট এ্যান্ড ওয়াচ। " রহস্যময় হাসি খেলে গেল পাভেলের মুখে।
জানালার কাছে গিয়ে সেটা পরীক্ষা করল ও। কাঠের ফ্রেমে লোহার শিক বসানো। শিকগুলো বেশ মোটামোটা।
" হুমম। বেশ পুরনো।" বলল পাভেল। তারপর গায়ের জ্যাকেটটা খুলে হাতে পেচিয়ে নিয়ে পাশাপাশি দুটো শিক ধরে গায়ের জোরে টানতে শুরু করল।
লোহার শিকের কিছু হলো না। কিন্তু ওর একরোখা জেদের কাছে কাঠের ফ্রেম হার মানল। দেয়াল থেকে খসে এল।
এবার পাভেল ওর পায়ের বুট খুলে তারমধ্যে বের করল একটা এটিএম কার্ড, নিজের আইডি কার্ড আর জাপানি হোন্ডাটার একটা ডুপ্লিকেট চাবি। তারপর সেগুলো জেসিকার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, "এই জঙ্গল্টা মনে হয় তোমার চেনা। তাই এখান থেকে বেরিয়ে গিয়ে সেই একতলা বাড়িটার গ্যারাজ থেকে গাড়ি নিয়ে সোজা লিটল রকে চলে যাবে। আমার অফিসে কন্টাক্ট করে হেল্প চাইবে। তারপর পুলিশ স্টেশনে যাবে। বুঝেছ ?"
"আর তুমি ?"
"আমি এখানে থেকে হারামজাদাগুলোর ওপর নজর রাখব। তুমি আর দেরী কোরো না। চলে যাও।"
জেসিকা চলে যাবার পর পাভেল পুরো ঘরটাকে আরো খুঁটিয়ে দেখল। এককোণা থেকে মেডিসিনের আর পঁচা গন্ধ আসছে। সেখানে দুটো কফিন বক্স রাখা। খুলে না দেখলেও পাভেল বুঝতে পারলো ওদুটোতে আরা শুয়ে আছে। হঠাৎ মাথায় বিদ্যুত খেলে গেল ওর। বুঝে গেল বিদায়ী ঘন্টা আসলে কি। বিদায় অর্থাৎ বাই এবং ঘন্টা মানে বেল। সুতরাং এর পুরো মানে হচ্ছে বাইবেল। আর বাইবেলটার কথা নিশ্চই জেসিকার জানা থাকবে।
সবকিছু বুঝতে পেরে রিল্যাক্স ভাব এসে ওর। ঘরের মধ্যে একটা কৌচ টাইপের চেয়ার পেল। ধূলা ঝেড়ে, জ্যাকেটটা পরে নিয়ে সেটায় বসল ও।
একটু পরে জ্যাকেটটার জিপার টেনে দিল। বেশ শীত পড়েছে।
খুব ভোরে ওর ঘুম ভেঙে গেল সাইরেনের শব্দে।
আন্দাজ করল পুলিশ সবদিক থেকে ঘিরে ফেলেছে। দুইপক্ষের মধ্যে প্রচণ্ড গোলাগুলি শুরু হলো।
পাভেল দরজার কাছে এসে দাঁড়াল। ওটা লাথি মেরে ভেঙে ফেলবে কিনা সেই ডিসিশান নেয়ার আগেই গোলাগুলির শব্দ ছাপিয়ে শুনতে পেল হম্যানের কণ্ঠ, রবার্ট, দেখতো শয়তানদুটো কি করছে ?
দরজার পাশের দেয়ালে পিঠ দিয়ে দাঁড়াল পাভেল। প্রায় সাথে সাথেই দরজা খুলে ঢুকল রবার্ট। তার হাতে একটা বড় স্প্যানিশ নাইফ। সে প্রথমেই এগিয়ে গেল ভাঙা জানলাটার দিকে। তারপর ফিরে যাওয়ার জন্য ঘুরে দাঁড়াতেই ভীষন চমকে গেল।
সেখানে পাভেল দাঁড়িয়ে আছে। "তোমাকে জাহান্নামে পাঠানোর জন্য আমি এখনো এখানে আছি, বাছা।" বলল পাভেল।
নাইফটাকে ওর গলা বরাবর চালাল রবার্ট। কিন্তু চট করে একপাশে সরে গিয়ে বিদ্যুতগতিতে তার কব্জিতে লাথি মারল পাভেল। নাইফটা ছিটকে দূরে গিয়ে পড়ল। এরপর রবার্টের কব্জির একটা বিশেষ জায়গায় চাপ দিয়ে গলায় কারাটে চপ মারল। স্রেফ একটা কাটা কলাগাছের মতো পড়ে গেল সে।
নিচু হয়ে রবার্টের নাইফটা কুড়িয়ে নিল পাভেল। কিন্তু পিছনে ফিরতেই রবার্টের মতো সেও চমকে গেল।
ওখানে দাঁড়িয়ে আছে হম্যান। তার হাতে বিদঘুটে কালো রিভলবার। ও কিছু বুঝে ওঠার আগেই নিজের কুৎসিত মুখটাকে রাগে আরো কুৎসিত করে, গালি দিয়ে ট্রিগার চাপল হম্যান।
সরে যাওয়ার চেষ্টা করল পাভেল। কিন্তু তার আগেই দেখতে পেল একটা গানফ্লাস আর সেইসাথে নিজের বামহাতে তীব্র ব্যাথা।
এরপর হম্যানের দিকে তাকালো। তার চোখ বিস্ফোরিত, মুখ বেয়ে রক্ত আর ফেনা গড়াচ্ছে। দুহাত দিয়ে টেনে বের করার চেষ্টা করছে বুকে বিঁধে থাকা বিরাট স্প্যানিশ নাইফটা।
এমন সময় ঘরে ঢুকল জেসিকা আর একজন পুলিশ অফিসার। জেসিকা দৌড়ে এল ওর দিকে।
হম্যান মরেনি। তাহলে তার পাপের তুলনায় সাজা অনেক কম হয়ে যেত। সাথে সাথে হসপিটালে নেয়ায় বেঁচে যায় সে। কিন্তু মরে গেলেই বোধহয় খুশি হতো সে। কারণ জেসিকার বাবার বাইবেলের লাইনিঙের ভিতরে পাওয়া গেল একটা এসডি কার্ড। তাতে হম্যানের বিরুদ্ধে অনেক এভিডেন্স। কিন্তু তদন্ত করে দেখা গেল ওর অপরাধের সংখ্যা আরও অনেক বেশি। এভাবে কেঁচো খুঁজতে গিয়ে একে একে সাপ, কুমির এমনকি ডায়নোসর পর্যন্ত বের হয়ে গেল।
হম্যানের গুলি পাভেলের হাতে সামান্য ফ্রাক্চার করেছে। ফলে হাতটা এখন স্লিংয়ে ঝুলছে। ও এখনও হেনরির সাথে যোগাযোগ করতে পারে নি। হেনরির নাম্বার বন্ধ।
হ্যারি আর তার মায়ের লাস্ট রাইটসের আয়োজন করা হলো। প্রিস্ট কফিন দুটোর সামনে প্রার্থনা করল। জেসিকা সে দুটোর উপর ফুলের তোড়া দিয়ে পাভেলের পাশে এসে দাঁড়াল। তার গায়ে কালো রঙের শোকের পোশাক।
কফিন দুটোর উপর দুটি ছবি রাখা হলো। হ্যারির কফিনের ওপর রাখা ছবিটা দেখে পাভেল চমকে উঠল।
"একি! এতো হেনরির ছবি। " চেঁচিয়ে উঠল ও।
" হ্যা তো কি হয়েছে ?" জেসিকা অবাক হয়ে প্রশ্ন করল।
উপস্থিত সবাই ওর দিকে অবাক হয়ে চাইল।
" কি হয়েছে মানে ? হ্যারির লাশের উপর হেনরির ছবি কেনো দেয়া হবে ?"
" পাগলের মতো কি সব আজেবাজে বকছ ! হেনরি আর হ্যারি তো একজনই। হেনরির ডাকনামই হচ্ছে হ্যারি। "
"হোয়াট ?" পাগলের মত চেঁচিয়ে উঠল পাভেল। দুই পা পিছিয়ে গেল।
"আর য়্যু ওকে ?"
উত্তর দিল না পাভেল। চোখ বুজে একে একে দেখতে পেল হেনরি, নেকড়ে আর ইঁদুরের অস্বাভাবিক জ্বলজ্বলে চোখ।
Author:
Ranveer Ahmed Robin
No comments:
Post a Comment