-মিনা শোন।
-হ্যাঁ ভাইয়া।
-চল।
-কোথায়?
-তুই না লুকোচুরি খেলবি বললি। আমি আর তুই লুকাব, অন্তু আমাদের খুজবে।
-আচ্ছা চলো।
অন্তু মিনার চাচাতো ভাই আর প্রান্ত মিনার ফুফাতো ভাই। দুজন পিঠাপিঠি বয়সের। মাত্র সপ্তম শ্রেণীতে পড়ে। মিনা অনেক ছোট। এখনো স্কুলে পদার্পন করেনি। বয়স মাত্র ৫ বছর। অত্যন্ত প্রফুল্ল প্রানবন্ত চঞ্চল একটা মেয়ে। মিনাদের যৌথ পরিবার। পরিবারে ওর সমবয়সী কেউ নেই বলে অন্তু, প্রান্ত ওদের সাথেই বড় হওয়া। প্রান্তর বাবা ওর অনেক ছোটবেলায় মারা যায় তাই নানা বাড়িতেই মানুষ সে।
যখন ওরা খেলছিলো মিনার মা তখন কাজে ব্যস্ত। সম্ভবত রান্না করছিলো। গ্রামের বাড়ি হওয়ায় রান্নাঘরটা খোলা জায়গায়। অনেকক্ষন ধরে মেয়ের কোনো সাড়া শব্দ পাওয়া যাচ্ছেনা। মিনা যেই চঞ্চল মেয়ে সে না ঘুমানো পর্যন্ত বোঝার উপায় নেই যে সে বাড়িতে নেই। তাহলে কোথায় গেলো? অন্তু, প্রান্ত ওদের ও দেখা যাচ্ছেনা। মিনার মা রান্নাঘর থেকে উঠে ঘরের দিকে এগিয়ে যান। মনের ভেতর কিসের যেনো একটা খটকা লাগছে। ঘরের ভেতরে গিয়ে দেখলেন একটা রুমের দরজা বন্ধ। সাধারণত এই ঘরের দরজা কখনো বন্ধ থাকেনা। ভেতর থেকে কেমন যেন একটা উদ্ভট শব্দ আসছে। দরজা ধাক্কা দিলেন মিনার মা। সাথে সাথে ঘরের ভেতরের শব্দটা নিশ্চুপ হয়ে গেলো। কিন্তু কেউ দরজা খুলছেনা। এবার মিনার মায়ের মনে সন্দেহ তৈরী হলো। তিনি জানালার কাছে গিয়ে দেখলেন জানালাটা খোলা। জানালার দিকে চোখ বাড়িয়েই যা দেখলেন তা কখনো কল্পনাও করেননি তিনি। মাথায় মুহুর্তেই যেন আকাশ ভেঙে পড়লো তার। তিনি চিৎকার করে উঠলেন। তার চিৎকার শুনে ঘরের ভেতরে থাকা অন্তু আর প্রান্ত তাড়াতাড়ি জামা কাপড় পড়ে ঘরের দরজা খুলেই দৌড়। আর বিছানায় বিবস্ত্র, অসহায় হয়ে পড়ে আছে তার ৫ বছরের মেয়েটা। মুখে কাপড় দেয়া, হাত দুটো বাধা। শব্দ করতে পারেছেনা মিনা। শুধু চোখ দিয়ে অজস্র অশ্রু ঝরছে। একজন মা হয়ে নিজের মেয়ের শরীরটাকে এভাবে হায়েনার মত আরেকজন কে ছিড়ে খেতে দেখেছে তিনি। এরচেয়ে নিষ্ঠুর যন্ত্রণা আর কি হতে পারে একজন মায়ের জন্য। মিনার মা মেয়ের কাছে এগিয়ে গিয়ে মেয়েকে জড়িয়ে ধরলেন। মুখের কাপড়টা সরাতেই মেয়ের চিৎকারে মায়ের কলিজাটা ছিদ্র হয়ে গেলো। মেয়েকে কোলে তুলে, মেয়েকে গোসল করান তিনি। কিন্তু মেয়ের সেই আর্তনাদ সহ্য করার শক্তি তার ছিলোনা। মেয়েকে কোলে নিয়ে নির্জীব হয়ে বসে আছেন একজন মা। কাদতে কাদতে একসময় নিস্তেজ হয়ে আসে মিনার শরীর। মারা যায়নি। ঘুমিয়ে পড়েছে মিনা।
সে সময় বাড়িতে কেউ না থাকায় ঘটনাটা সম্পর্কে কেউ অবগত ছিলোনা। অন্তুর মা বাড়িতে আসার পর তাকে গিয়ে সবকিছু খুলে বলেন মিনার মা। কিভাবে তার ছেলে আর প্রান্ত দুজন মিলে তার ৫ বছরের বাচ্ছাটা কে ছিড়ে খেয়েছে। এসব শুনে অন্তুর মা আকুতি মিনতি করে আর কাউকে এ ব্যাপারে কিছু না বলতে, বিশেষ করে মিনার বাবাকে। মিনার বাবার কাছে মেয়ে তার জান। যদি সে জানতে পারে তাহলে অন্তু আর প্রান্তকে জবাই করতেও তার বিন্দু পরিমাণ হাত কাপবেনা। মিনার মা সরাসরি জানিয়ে দেয়, সে তার মেয়ের সাথে হওয়া নৃশংস ঘটনার বিচার চায়। হঠাৎই অন্তুর মা হাসতে থাকে। এই হাসির রহস্য না বুঝতে পেরে প্রশ্নবোধক ভঙ্গিতে তাকায় মিনার মা। অন্তুর মা তখন বলে,
"হ্যা যাও, গিয়ে সবাইকে বলো৷ আমাদের না হয় বাড়ি থেকে বের করে দেবে, আমরা অন্যকোথাও চলে যাবো। ওরা ছোট মানুষ, খেলার ছলে একটু এসব হয়। আর আমার ছেলে নাবালক হওয়ায় কোনো শাস্তিও হবেনা৷ কিন্তু তোমার মেয়েকে তো এই সমাজেই বড় হতে হবে। বড় হয়ে সমাজে মুখ দেখাবে কি করে৷ সবাই ধর্ষিতা হিসেবেই চিনবে। তখনও কি আবার বিচার চাইবে?"
কথাটা শুনে মিনার মা মাটিতে বসে পড়লো। নিজ চোখে সবকিছু দেখেও বিচার চাওয়া হলোনা একজন মায়ের। মিনা তো মেয়ে। যে যাই দোষ করুক না কেনো, সম্মানহানি একজন মেয়েরই হয়। তার মেয়েকে সবাই ধর্ষিতা হিসেবে চিনুক একজন মা তা মেনে নিতে পারেনা। তাই তিনিও আর কারো কাছে বিচারের আকুতি করেননি।
যেমন সব মিনারা রাজুদের মত ভাই পায়না, তেমনি সব মায়েরা সন্তানের জন্য নায্য বিচার চাইতে পারেনা।
এভাবেই শত শত মিনাদের গল্প সবার অগোচরেই থেকে যায়। কিছু প্রকাশ পায় যা প্রতিবার শিক্ষা দিয়ে যায়, এ সমাজে ধর্ষিতার কোনো সম্মান নেই….
(সত্য ঘটনা অবলম্বনে)
Author:
Farhana Akter Mim
Studies at Khulna University of Engineering and Technology (KUET)
No comments:
Post a Comment