-আচ্ছা তিশা আমরা ঠিক আর কতদিন একসাথে আছি?
অর্নবের এই প্রশ্নে বেশ অবাক হলো তিশা৷
-এ কেমন প্রশ্ন? অবশ্যই মৃত্যুর আগ পর্যন্ত।
-সেটাই তো জিজ্ঞেস করছি সময়টা আর কতদিন?
-সেটা আমি কিভাবে বলবো।
অর্নব অনেক গভীর চিন্তার মানুষ। ছোট একটা বিষয় নিয়েও এমনভাবে চিন্তা করে যা একজন সাধারণ মানুষের কল্পনারও বাহিরে। আর তিশা ঠিক উল্টোটা। জীবন নিয়ে এতো ভাবাভাবির সময় তার নেই। শুধু ক্যারিয়ার নিয়ে ফোকাসড সে।
-সবাই যে বলে জীবন অনেক বড়,এই কথাটা যে ভুল তা কি জানো তিশা?
-বড় নাকি ছোট সেটাতো নির্ভর করে কে কতটুকু এবং কিভাবে সময়টাকে কাজে লাগিয়েছে।
-নাহ। তোমাকে একটা ছোট্ট হিসেব দেই দেখো।
মানুষের গড় আয়ু কত? ৬০ বছরের মত। আমাদের একটু আকটু বোঝার বয়স হয় কমপক্ষে ৯/১০ বছর থেকে। এই সময়টাতে কিছু বোঝার চেষ্টা করতে করতেই কৈশোরকালে পদার্পণ করি। এই সময়ে পৌছানোর পর আমরা একটু বেশিই বুঝতে শুরু করি। শুরু হয় বাবা মার থেকে দূরত্ব। তারপর জীবনের অনেক ভুল, অনেক রোমাঞ্চকর স্মৃতি, অনেক আবেগ, বাস্তব জীবনের কিছু শিক্ষা এসব নিয়েই দেখতে দেখতে কৈশোরকালটা শেষ হয়। জীবনের প্রথম ভালোবাসাটাও বোধ হয় এই সময়টাতেই আসে। বয়স ১৮-র পর থেকে জীবনটাকে বুঝতে শুরু করি। আর সেই মূহুর্তেই পড়াশোনা বা কাজের কারনে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে পড়া। ব্যাস পরিবার থেকে দূরত্বটা আরো অনেকটা বেড়ে গেলো। মাস ছয়েক পর পর বাড়িতে আসা আর বাড়িতে এসেও এই আত্নীয় সেই বন্ধু এসবেই সময়টা শেষ। এসময় মনে অনেক আশা-আকান্খা নিয়ে ভবিষ্যতের পেছনে ছুটতে থাকি। আমাদের বয়স ১৮ মানে আমাদের বাবা মায়েদের বয়স কমপক্ষে ৩৬ বছর। তাহলে বাবা-মা আমাদের সাথে আর ঠিক কত সময় আছে? ভেবে দেখেছো একবার?
আচ্ছা এরপর বলি,
বয়স ২৩/২৪ এ গিয়ে পড়াশোনা নামক ১৮/২০বছরের পথচলা মোটামুটিভাবে সম্পূর্ণ হয়। হায়ার স্টাডিজ এর হিসেব এখানে বাদই দিলাম। বয়স ২০ হওয়ার সাথে সাথেই জীবনের এক-তৃতীয়াংশের কোটা কিন্তু সম্পন্ন হয়ে গেছে। পড়াশোনা শেষ হওয়ার পর এবার চাকরীর জন্য বছরখানেক দৌড়াদৌড়ি। পুরোপুরি সেটেল না হলে ভালো মেয়ে পাওয়া যাবেনা যে। সেটেল হতে হতে বয়স ৩০-এর কাছাকাছি চলে গেছে৷ অর্ধেকটা জীবন শেষ। আর মেয়েদের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ গ্রাজুয়েশন পর্যন্ত অপেক্ষা করে বাবা-মা। কিন্তু এই ২৫-৩০ বছর বয়সটাকে আমরা আমাদের স্বাধীনতা বয়স হিসেবে রাখি।
-যেমন?
-যেমন, এই ধরো ছোটবেলায় আমরা স্বপ্ন দেখি কিন্তু সেটাকে বাস্তবায়ন করার সামর্থ্য আমাদের থাকেনা। তুমি হয়তো যখন দেশ-বিদেশ ঘোরার স্বপ্ন দেখেছো,তখন নিশ্চয়ই আম্মু তোমাকে তোমাকে বলেছে বিয়ের পর স্বামীর সাথে যাস তেমনি আমাকেও বাবা বলেছে বড় হয়ে যখন নিজের পায়ে দাড়াবি তখন যাস। এখন দেখো সামর্থ্য আছে কিন্তু সময় নেই।
এবার শুরু হলো সংসার জীবন। এসময়ে এসে আরো বছর খানেক চলে যায় নিজেদের কে সংসারী হিসেবে প্রস্তুত করতে। অনেক পরিশ্রম করি আমরা যাতে আমাদের সন্তানদের কষ্ট করতে না হয়। এতোদিনে তোমার বয়স ২৮/২৯ এর মতো আর আমার ৩৪/৩৫ এর মতো। এবার আমাকে একটু বলো আমাদের সন্তানরা আমাদেরকে আর ঠিক কতটা সময় কাছে পাবে?
এরপর আমাদের সন্তান আমাদের মাঝে আসবে। তারপর তার শিশুকাল, বাল্যকাল, কৈশোরকাল দেখতে দেখতে আমরা ৪৫-৫০ এর বছরে পদার্পণ করবো। তারপর আমাদের একটু বিশ্রাম প্রয়োজন হবে। কিন্তু তখনও আমরা পরিশ্রম করে যাবো কারণ আমাদের সন্তান এখনো ওই অব্দি পৌছায়নি। ৫০-৫৫ এর মধ্যে গিয়ে দায়িত্বটা একটু কমবে। তখন আবার বছরখানিক সময় হাতে পাবো। কিন্তু চলার শক্তি খুব একটা থাকবে বলে মনে হয়না….
এই গেলো সর্বোচ্চ অনুমান। এরমধ্যে যদি কোনো দূর্ঘটনা ঘটে যায় বা বড় কোনো অসুখ ধরা পড়ে তাহলে ৬০ এ পৌছানোর অনেক আগেই শেষ।
অথচ দেখো এই ছোট্ট সময়টাতেও ভবিষ্যতের চিন্তা করতে করতে বর্তমানটাকে ভুলে যাই। আর এভাবেই জীবনের অনেক সময় আমরা এমনিতেই হারিয়ে ফেলছি। জীবনের সময়গুলো চলে যাচ্ছে। আমরা মৃত্যুর দিকে ধাবিত হচ্ছি। ভালো থাকার জন্য অনেক বেশী কিছু দরকার পড়েনা কিন্তু আমরা জীবনটাকে উপভোগ করছিনা। শুধু ভবিষ্যতের জন্য দৌড়াচ্ছি।
তিশা এক দৃষ্টিতে অর্নবের দিকে তাকিয়ে আছে। কিছু বলছেনা।
-তিশা কি হলো, আমার বলা শেষ। তুমি যাও একটু ঘুমিয়ে নাও। তোমার যাওয়ার সময় হয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি উঠতে হবে।
তিশা স্কলারশিপ পেয়ে দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে। তিশা আর অর্নব স্বামী-স্ত্রী। তবে বিয়েটা চুক্তির। তিশাকে বাসা থেকে বিয়ের জন্য তাড়া দেয়ায় তিশা বিয়ে করে অর্নবকে। বিয়ের পর অর্নব জানতে পারে তিশা ইচ্ছের বিরুদ্ধে বিয়ে করেছে এবং সে সারাজীবনের জন্য দেশের বাইরেই সেটেল হতে চায়। আর অর্নব তার বাবা-মা কে ছেড়ে যাবেনা তাই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তিশা একাই সেখানে থাকবে।
তিশাকে বিদায় দেবার পালা। এই চুক্তির মধ্যেও অর্নব তিশাকে ভালোবেসে ফেলেছে৷ কিন্তু আটকানোর সামর্থ্য তার নেই।
-ভালো থেকো অর্নব।
-তুমিও।
তিশা চলে গেছে।
রাস্তায় হাটছে অর্নব। পেছন থেকে কে যেনো ডাকছে মনে হচ্ছে।
-তিশা তুমি এখানে কি করছো। তোমার ফ্লাইট না ৪টায় ছিলো। আর তুমি কাদছো কেন কি হইছে?
-আমি যাবোনা।
-মানে কি? কেন?
-জীবনে যতটুকু অর্জন করেছি তাতে ভালোমতোই ভবিষ্যৎ পার করতে পারব কিন্তু ভালোবাসা যদি আর না পাই? এমনিতেও হাতে সময় বেশি নেই। আম্মু-আব্বুর সাথেও অনেকটা সময় পার করতে হবে। বাসায় চলো প্লিজ।
অর্নব কি বলবে বুঝতে পারছেনা। "মেয়েটা সত্যিই কি ভালোবাসার কারণে চলে এসেছে?"
জীবনের প্রত্যেক মূহুর্তই অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কেউ ভবিষ্যতের জন্য বাঁচে আর কেউ বাঁচার জন্য বাঁচে। অবশ্যই ক্যারিয়ার অনেক গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু তার জন্য কাছের মানুষগুলো কে যে পেছনে ফেলে যাচ্ছেন তার দিকে একবার তাকিয়ে দেখেছেন? দেখা যাবে একসময় আপনি অনেক আগে চলে গেছেন কিন্তু পেছন ফিরে দেখবেন আপনার আশেপাশে কেউ নেই। যেই ভবিষ্যতের জন্য আপনি থাকবেন কিনা ঠিক নেই, আপনার প্রিয়জন থাকবে কিনা ঠিক নেই তার পেছনে প্রয়োজনের বেশি দৌড়ে বর্তমানটা কেন হারাচ্ছেন?
Author:
Farhana Akter Mim
Studies at Khulna University of Engineering & Technology
No comments:
Post a Comment