রাস্তায় হাটতে হাটতে হঠাৎ পায়ে কি যেন একটা বেধে গেলো। "ওহহো আরেকটু হলেই তো পড়েছিলাম, এটা এখানে কে ফেলে গেছে"। তন্ময় হাতে নিয়ে দেখলো একটা ডায়েরি, তবে ডায়েরিটা বেশ পুরনো। "চেনা চেনা লাগছে, এটাকে কোথায় যেন দেখেছি। যাইহোক আমার কাছে রেখে দেই কেউ খোঁজ করলে তখন দিয়ে দেয়া যাবে।" বাসায় এসে পড়ার টেবিলে ডায়েরিটা রেখে দিলো। রাতে খাওয়াদাওয়া শেষ করে নিজের ঘরে বসে ভিডিও গেমস খেলছে। এরি মধ্যে তন্ময় এর মা কক্ষে প্রবেশ করলো।
-"কিরে তুই এখনো না ঘুমিয়ে কি করছিস।"
- "না মা কিছুনাতো"
- "আমি দিব্যি দেখলাম তুই গেম সেট হাতে খেলছিস। এখনো ঘুমাস নি, সকালে স্কুল যাবি কি করে। ওটা আমাকে দে এখন। কাল স্কুল থেকে এসে খেলিস।"
তন্ময় আর কিছু না বলেই লক্ষী বাচ্চার মতো গেম সেট টা মা কে দিয়ে দিলো। কিন্তু ঘুম যে আর আসছে না। অনেকক্ষন যাবত এপাশ ওপাশ করতে করতে করতে হঠাৎ টেবিলের ওপর রাখা ডায়েরিটা চোখে পড়লো। তন্ময় বিছানা থেকে উঠে গিয়ে ডায়েরিটা হাতে নিলো। কৌতূহলবসতো ডায়েরির প্রথম পৃষ্ঠা খুলে পড়া শুরু করলো।
"মা আমি বেরচ্ছি, অফিসের জন্য দেরি হয়ে যাচ্ছে।" বলেই বাসা থেকে বের হয়ে গেলাম। পথিমধ্যে প্রানন এর ফোন, -"কোথায় তুই?"
-"অফিস যাচ্ছি,কেন?"
-"আজ তুই অফিস যাস না।"
-"ওমা অফিস কেন যাবোনা।"
-"আজ তোর রাশি অশুভ।"
-"তাতে কি? আর তোকে কতবার না বলেছি এসবে আমি বিশ্বাস করিনা। তুই ও বা কবে তোর এসব ভ্রান্ত ধারণা দূর করবি বলতো।"
-"আরে আমি আজ পীরের এর কাছে গিয়েছিলাম তাই ভাবলাম তোর কথাও জিজ্ঞেস করে আসি ।"
-"তুই আবার ওই ভন্ড লোকটার কাছে গিয়েছিলি প্রানন?"
-"আরে চুপ করতো তুই, তোর কোনো ধারণাই নেই ওনার সম্পর্কে। এখন আমার ভুল ধরা বাদ দিয়ে শীগ্রই আমার বাসায় চলে আয়।"
-"আরে বাবা আজ অফিস যেতেই হবে, অনেক গুরুত্বপূর্ণ মিটিং আছে।"
-"দেখ তোর ভালোর জন্য বলছি প্লিজ যাসনা, আজকের দিন তোর জন্য একদমই শুভ না।"
-"আজকের দিন কতটুকু শুভ না অশুভ তাতো আমি জানিনা কিন্তু আজ অফিস না গেলে চাকরিটা যে আমার থাকবেনা এতটুকু নিশ্চিত। আমার অফিস বাস চলে এসেছে আমি ফোন রাখছি পরে কথা বলি।"
-"আরে শোন"…..
প্রাননের ফোনটা কেটে দিয়ে অফিস বাসে উঠে পড়লাম। অফিস পৌছে মিটিং টা শেষ করলাম। আমার প্রেজেন্টেশনটা সবাই বেশ পছন্দ করেছে। এবার বোধহয় পদোন্নতিটা হয়েই যাবে। সারাদিনের ব্যস্ততা শেষে এখন বাড়ি ফেরার পালা। প্রাননটা যে বললো আজকের দিন আমার জন্য শুভ নয়। আজকের দিনটা তো দিব্যি কেটে গেল। ওকে গিয়ে বোঝানো দরকার। এই পীরের পেছনে ছুটতে ছুটতে কোনদিন যেন পাগল হয়ে যাবে। ছেলেটা এতো যে কুসংস্কার মানে। যাইহোক বাড়ি পৌছে কথা বলে নেবো ওর সাথে। বাস চলছে। সারাদিনের ক্লান্তটায় চোখটা লেগে এসেছে। হঠাৎ চারিপাশে চিৎকার শুনতে পেলাম।
কিছু বুঝে ওঠার আগেই বিকট একটা শব্দ হলো। সবকিছু যেন ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। উঠে দাড়ানোর শক্তিও পাচ্ছিনা। মনে হচ্ছে আমি হারিয়ে যাচ্ছি। একসময় সব অন্ধকারে ছেয়ে গেলো।
চোখ খুললাম। কোথায় আছিতো কে জানে। আমি নড়াচড়া করতে পারছিনা। শরীরে প্রচন্ড ব্যাথা। কিছুক্ষন পর বুঝতে পারলাম আমি হাসপাতালে। সেদিন বাসের ব্রেইক ফেল হয়েছিলো আর বাস একটি পিলারের সাথে ধাক্কা খায়। ঘটনাস্থলে নিহত ৩জন। আমি একটুর জন্য বেচে গেছি। ৩দিন পর চোখ খুলেছি। মা-বাবা, আত্মীয়স্বজন সবাই এসেছে আমাকে দেখতে কিন্তু প্রানন কে তো দেখছি না। এইতো প্রানন এসে গেছে।
-"কোথায় ছিলি তুই?"
-"তোর জন্য তাবিজ আনতে গিয়েছিলাম।"
-"আবার এসব.."
-"একদম কথা বলবিনা তুই। সেদিন যদি আমার কথা শুনতি তাহলে এরকম অবস্থা হতোনা। যদি আরো বাজে কিছু হতো একবার ভেবে দেখেছিস।"
প্রানন এর কথাটা শুনেই একদম চুপ হয়ে গেলাম। আসলেই তো, কিন্তু এটাও বা কিভাবে সম্ভব। দূর্ঘটনার সাথে রাশির কি সম্পর্ক। ধুর আমিও যে কিসব ভাবছি। এগুলো সব কাকতালীয় ঘটনা।
সুস্থ হতে কিছুদিন সময় লাগছে। কবে যে অফিস যাবো।
যাক অবশেষে আজ অফিস যাচ্ছি। এখন মোটামুটি সুস্থ। আমার বাকি সহকর্মীরাও প্রায় সুস্থ হয়ে উঠেছেন। কিন্তু ৩ জন মানুষকে আর কখনো সাথে পাবোনা। ভাবতেই চোখে মুখে একটা বিমূর্ষ ছায়া এসে পড়েছে। না জানি ওদের পরিবার কেমন আছে। আর তীর্থদের পরিবার? ওর পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ওই ছিলো৷ অফিস শেষে একবার ওদের বাসায় যাবো। আমাদেরই তো দায়িত্ব ওনাদের খোঁজ খবর নেয়া। অফিস শেষে বের হতেই দেখি বাইরে প্রচন্ড বৃষ্টি হচ্ছে। এই অবস্থায় তো আর ওদের বাসায় যাওয়া সম্ভব না। অন্য একদিন যাবো, আজ বাসায় যাই। কাল অফিস পৌছে আগে তীর্থর বাসার নাম্বার যোগাড় করতে হবে।
তীর্থর বাসার নাম্বার পেয়ে গেছি। আগে একটা ফোন দিয়ে দেখি। ফোন রিসিভ করলো একটি মেয়ে,
-কে বলছেন?
-জী আমি তীর্থর বন্ধু।
-জী ভাইয়া বলুন। আমি দাদার ছোট বোন।
-আপনারা কি বাসায় আছেন। আমি একটু দেখা করতে আসতাম।
-জি ভাইয়া আমরা বাসাতেই আছি।
-আচ্ছা ঠিকাছে।
আজ অফিস থেকে আধ বেলার ছুটি নিয়ে বের হয়েছি। পথিমধ্যে সামান্য কিছু বাজার করে নিয়েছি।
বাসার সামনে পৌছে কলিং বেল বাজানোর আগেই দরজাটা খুললো একজন। শ্যাম বর্ণের একটি মেয়ে, চোখ তার টানাটানা, চেহারায় বিনম্রতার ছাপ। মেয়েটিকে দেখেই যে কারো পক্ষে তার সরলতা পরিমাপ করা সম্ভব। হাসলে বোধহয় মেয়েটাকে আরো প্রানোবন্ত লাগে।
ঘরে প্রবেশ করলাম। আন্টি অনেক অসুস্থ। তীর্থর বাবা অনেক আগেই মারা গেছেন। বোন মাত্র উচ্চ মাধ্যমিক ২য় বর্ষে পড়ে। মা ও বোন কে নিয়েই তীর্থর পরিবার। কিন্তু সেও আজ নেই।
-আন্টি কে ডাক্তার দেখিয়েছো?
- না ভাইয়া।
-কেন?
-আজ ২দিন ধরে ঘরে খাবার নেই। ভাইয়ার জমানো কিছু টাকায় একমাস চললাম। মাকে খাওয়াতেই পারছিনা ঠিকভাবে আর ডাক্তার।
কথাটা শুনতেই নিজের ভেতরটা হাহাকার করে উঠলো।
-এইনাও কিছু টুকিটাকি খাবার এনেছি তোমাদের জন্য আর এই টাকাটা রাখো আন্টি কে ওষুধ এনে দিয়ো।
-আরে না না ভাইয়া এই টাকা আমি নিতে পারবোনা। আমি কোনো একটা ব্যবস্থা করে নেবো।
-আরে পাগলী এখন রাখো। যদি এমনি না নিতে মনে চায় তাহলে ধার হিসেবেই নাও। যখন পড়ালেখা করে আরো বড় হবে তখন নাহয় ফেরত দিয়ে দিও। আর যেকোনো প্রয়োজনে আমাকে ফোন দিও।
এখন প্রায়ই ওদের খোঁজ খবর নেই। কালও ওদের বাসায় গিয়েছিলাম। কিন্তু মিশুর (তীর্থর বোন) আত্মসম্মানবোধ এতো বেশি যে সেদিন দেয়া টাকাটা শোধ করে দিয়েছে। তাই অফিস থেকে পাঠিয়েছে বলে টুকটাক হাত খরচ দিয়ে আসি মাঝেমধ্যে। এমনি না খেয়ে থাকলেও মেয়েটা আজ অব্দি আমাকে কখনো ফোন দেয়নি।
ওই দূর্ঘটনার প্রায় ৭মাস হয়ে গেছে। আজ হঠাৎ মিশু আমাকে ফোন দিয়েছে। ও কখনো ফোন দেয়না তো, কোনো বিপদ হলো না তো।
ফোন ধরতেই, (কাঁদতে কাঁদতে)
-ভাইয়া, আম্মুউউউ….
- হ্যালো…
ফোনটা কেটে গেলো। খারাপ কিছু হয়েছে এতটুকু তো নিশ্চিত। সাথে সাথে ওদের বাড়িতে পৌছালাম। গিয়ে দেখি বাইরে অনেক মানুষের ভিড়। জানতে পারলাম আন্টি আর নেই। কিন্তু কেউ ঘরের ভেতর যাচ্ছেনা। আন্টি গুটি বসন্তে মারা গেছেন। যা কিনা ছোয়াচে। আমি ভেতরে যেতেই কয়েকজন আমাকে বাধা দিলো। কারো কথা না শুনেই ভেতরে গেলাম। মেয়েটা একা একা নিস্তেজ হয়ে পড়ে আছে মায়ের পায়ের কাছে। রোগটা ছোয়াচে বলে কেউ দাফন কাফনে এগিয়ে আসছে না। এদিকে আমি একা কি করবো তাও বুঝতে পারছিনা। প্রায় ৭ ঘন্টা ধরে উনি এভাবেই আছেন। বন্ধুদের ফোন করে বলায় সাথে সাথে অনেকজন চলে এসেছে। কেউ পরোয়া করেনি ছোয়াচে রোগের। ওরা কয়েকজন মিলে ওদের ধর্মীয় যাবতীয় কাজ সম্পন্ন করলো। এবার নিয়ে যাবার পালা। আমি এক মূহুর্ত চিন্তা না করে বাকিদের সাথে মিলে খাটিয়া তুললাম। জানিনা কতটুকু ঠিক বেঠিক কিন্তু ওই মূহুর্তে ওনাকে ওঠানোর মানুষ পর্যাপ্ত ছিলোনা। তাই আমিই এগিয়ে গেছি। সংস্করন শেষ করে ফিরে এসে দেখি প্রানন এখানে।
-তুই এখানে?
-সবাই বললো তুই এখানে তাই আসলাম। যদি কোনো দরকার পড়ে। তা তুই কোত্থেকে আসছিস?
-সংস্করনে গিয়েছিলাম।
-কিহ। মাথা ঠিকাছে? ভুলে গেছিস ওরা হিন্দু।
ওর কথাটা শুনেই আশেপাশে যারা ছিল সবাই আমাকে গ্রাস করার ভঙ্গিতে তাকিয়ে রইলো।
-আমি শশ্মানে প্রবেশ করিনি। শুধু ওই পর্যন্ত পৌছে দিয়েছি।
একজন বলে উঠলো,
-হায়, হায় মুসলিম হয়ে হিন্দুর সৎকার।
আমার বান্ধুবি আন্নি সেখানে ছিলো ওকে ডেকেছিলাম মিশুর খেয়াল রাখতে। জবাবে বললো,
-কেন? যখন ৭ ঘন্টা ধরে উনাকে ফেলে রাখা হলো তখন আপনাদের নীতি কোথায় ছিলো। মৃতব্যক্তির জানাযা/সৎকার তাদের হক। তখন আপনারা কোথায় ছিলেন। কেউতো এগিয়ে আসেননি। ছোয়াচে বলে সবাই শুধু তাকিয়ে দেখেছেন। মিশুর চোখের পানি মুছে দেয়ার জন্যেও কি এগিয়ে এসেছিলেন? এবার কেউ কোনো উত্তর না দিয়ে একে একে চলে গেলো। মিশু কে আমাদের বাসায় নিয়ে এসেছি। ও এখনো কোনো কথা বলছে না। মা পানি এনে পানি ছিটাতেই স্বাভাবিক হলো আর কান্নায় ভেঙে পড়লো। কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়লো ও। এরপর মা কে সব ঘটনা খুলে বললাম। মাকে বললাম যাতে ও এখন থেকে আমাদের সাথেই থাকে। এমনিতেও ওর কেউ নেই যাবেও বা কোথায়। আজ আমি মায়ের অন্যরকম একটা রুপ দেখলাম। আশেপাশের মানুষ, আত্মীয় স্বজনের কটাক্ষ কোনো কিছুর পরোয়া না করেই রাজি হয়ে গেলো। বাবাও স্বায় দিয়ে বললেন, "সেটাই বাচ্চা মেয়েটা কোথায়ই বা যাবে। মিশু এখন থেকে আমাদের সাথেই থাকবে।"
আজ অনেক গর্ববোধ হচ্ছে। মন থেকে অনুভব করতে পারছি, মনুষত্ব্যের ওপর কিছুনেই। কে বলেছে পৃথিবীতে মানবতা নেই? যদি না থাকতো, তাহলে এতগুলো মানুষ রোগটা ছোয়াচে জেনেও এক ফোন কলে চলে আসতো? আমার বাবা-মা যারা কিনা বিন্দু পরিমান ভাবেনি ভিন্নধর্মের একজন মানুষকে আপন করে নিতে। এর পরেও কি বলবেন মানবতা নেই। মানবতা আমাদের সবার মাঝে বিদ্যমান, দরকার শুধু নিজেদের বিবেক কে জাগ্রত করা।
একি ডায়েরির পৃষ্ঠা শেষ। আরকিছু লেখা নেই কেনো। তারপর মিশুর কি হলো? মিশু কি সেখানে ছিলো? এত আত্ম-সম্মান প্রখর মেয়েটা রাজি হয়েছিলো কি সেখানে থাকতে? হাজারো প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে তন্ময়ের মনে।
ভোর ৪টা বাজে। গল্পের শেষটা কল্পনা করতে করতেই মাথার কাছে ডায়েরিটা রেখে ঘুমিয়ে পড়লো তন্ময়। হয়তো নিজের স্বপ্নের মধ্যেই শেষ টা নিজের মতো গুছিয়ে নেবে সে।
তারপর মিশুর কি হলো?....
তারপর মিশুর কি হলো?....
Author:
Farhana Akter Mim
Studies at Khulna University of Engineering & Technology
©copyright 2020. All rights reserved by storylandbd
No comments:
Post a Comment