শেষ চিঠি...| The last Letter




প্রিয় আর্য,
এই মূহুর্তে যখন তুমি আমার চিঠি টা পড়ছো, আমি তোমার থেকে অনেক দূরে। জানি আর কখনো আমাদের দেখা হবেনা, কখনো কথাও হবেনা,আর কখনো চায়ের দোকানে বসে স্মৃতি জমা করার সুযোগটাও হবেনা। ইশ আর কিছুটাদিন যদি সময় পেতাম। সময়টাকে যদি মায়ার শিকলে বেধে রাখা যেত, আমাদের কাটানো সময়টাকে কখনো যেতেই দিতাম না। কিন্তু আজ দেখো সেই সময়টাই ফুরিয়ে গেছে। জানো অনেক কিছু বলার আছে তোমাকে। নিজের কাছে এত কথা থাকার পরেও কিছুই লিখতে পারছিনা। নিজের মত যেন কথাগুলোও হারিয়ে যাচ্ছে। 

তোমার মনে আছে আর্য, আমাদের প্রথম দেখা? তিশা কে বিরক্ত করার কারনে তোমাকে প্লাবন ভেবে কি বকাটাই না দিয়েছিলাম। আর যখন আমি ভুলটা বুঝতে পারলাম তুমি আমাকে কিছু না বলেই মুচকি হাসি দিয়ে চলে গেলে।  অন্যকেউ হলে যে আমার কি হতো কে জানে। এরপর থেকে সবার চোখ আড়াল করে প্রতিদিন চুপিচুপি একজন আরেকজনকে দেখা, যাওয়া আসার সময় হিসেব করে রাস্তায় অপেক্ষা করা, সে যেন এক অদ্ভুত ভালোলাগা।

আমিও একদিন তোমাকে না দেখলে আশেপাশে উঁকি দিতে থাকতাম। আর যেদিন তুমি আমাকে প্রপোজ করলে সেদিন টা আমার জীবনের অন্যতম গুরুত্ত্বপূর্ণ দিন ছিলো। আমার সাদা গোলাপ পছন্দ বলে তুমি পুরো ১২ টা সাদা গোলাপ এনেছিলে। যার প্রত্যেকটাই একেকটি বর্ণ বহন করে। "আ-মি_তো-মা-কে_ভা-লো-বা-সি_অ-ব-ন্তি।" সবকিছুই যেন একদম স্বপ্নের মতো ছিলো। এরপর থেকে কতো ঝগড়া, ভালোবাসা, খুনসুটি সবকিছু মিলেই হাজারো স্মৃতি জমা হয়েছে। গত সাড়ে তিন বছর ধরে যেন সেই স্বপ্নের মধ্যেই ছিলাম। কিন্তু ভাগ্যের এমন নির্মম পরিহাস যে আমাদের কাটানো শেষ সময়টুকুও কখন যে শেষ হয়ে গেছে বুঝতেই পারিনি। জানলে হয়তো সেদিন আরেকটু সময় তোমার সাথে থেকে যেতাম।

যাইযোক এখন যা বলছি মন দিয়ে শোনো তুমি অনেক অগোছালো। কিন্তু এখন থেকে নিজের খেয়াল নিজেকেই রাখতে হবে। পাগলামী করবে না একদম। খাওয়া দাওয়া একদম সময় মতো করবে। আর যদি সম্ভব হয় আরেকবার কাউকে ভালোবেসো। দেখবে কেউ একজন আবারো তোমার জীবনে এসে তোমার জীবনটাকে সুন্দর করে তুলবে। 
জানি সারাজীবন তোমার আমার উপর অভিযোগ থেকেই যাবে কেন তোমাকে কিছু জানালাম না। কিন্তু বিশ্বাস করো তোমার কাছ থেকে শেষবিদায় নেয়ার সাহস আমার হয়নি। তবুও শেষ বেলায় তোমাকে ফোন দিয়েছিলাম একবার কিন্তু তুমি হয়তো ব্যস্ত ছিলে, তাই না বলেই চলে গেলাম। কখনো কোনো ভুল করে থাকলে আমাকে ক্ষমা করে দিয়ো। আর নিজের খেয়াল রেখো আর্য।

ইতি
অবন্তি.

অবন্তির লেখা শেষ চিঠিটা আর্যর হাতে পৌছে গেছে। আর্য চিঠি পড়ছে। পুরো চিঠিটা পড়া শেষে একটা মুচকি হাসি দিয়ে উঠলো। চোখে মুখে যেন প্রশান্তির ছায়া। আর্যকে দেখে মনে হচ্ছে অনেকদিনের বোঝ মাথা থেকে নেমে গেছে। এরই মধ্যে আর্যর মা এলো। চিঠিটা তার হাতে দিয়ে বললো, "মা দেখো অবন্তির চিঠি। ও চলে গেছে। আর কখনো ফিরবেনা। এবার আমি নিশ্চিন্তে থাকতে পারবো।" 


এরি মধ্যে জনৈক এক মহিলার প্রবেশ, "আর্যকে নিয়ে যাওয়ার সময় হয়ে গেছে। আপনি দয়া করে এখানে একটি সই করে দিন।"
মা-"এটা কি?"
জনৈক মহিলা-" বন্ড পেপার, অপারেশন এর দরুন রোগীর যদি কিছু হয় সেই দায়িত্ব হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের নয়"।
মা-" এটাতে কি সই করতেই হবে?"
জনৈক মহিলা-"জী হ্যা, রোগীর বাঁচার সম্ভাবনা মাত্র ৩৫% তাই যেকোনো কিছুই ঘটতে পারে। আপনি সই করার পর আমরা ওকে নিয়ে যাবো।"

গত ৫ মাস আগে আর্যর ব্রেইন টিউমার ধরা পড়ে মেজর স্টেজে। একারনে আর্য ফাইনাল ইয়ারের পরীক্ষাটা সম্পন্ন করতে পারেনি। ফাইনাল ইয়ার শেষ করেই ওদের বিয়ে করার কথা ছিলো। আর্য তার অসুস্থের কথা অবন্তিকে জানায়নি। অবন্তি রেজাল্টের কথা জিজ্ঞেস করায় সে বলেছিলো "অবন্তি এই সেমিস্টারে আমি ব্যাকলগ খেয়েছি"। সেদিন অবন্তি আর একটা কথাও না বলে চলে গিয়েছিলো। বিশ্বাসটা হয়তো ওই ফলাফলের ভিত্তিতেই ছিলো। ওইদিনের পর ওদের আর দেখা হয়নি কখনো। কিছুদিনের মধ্যে অবন্তির জন্য ভালো সম্বন্ধ আসে। ছেলে নাকি অনেক হাই প্রোফাইলের। কিন্তু সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে অবন্তিও তাদের সাড়ে তিন বছরের সম্পর্ক ভুলে মূহুর্তেই রাজি হয়ে যায়। কিন্তু ওর ভয় ছিলো, আর্য যদি কোনো বাধা দিতে আসে। অনেক কাছের মেয়েটা হঠাৎ করেই অনেক অচেনা হয়ে গেলো। একবার আর্যকে জানানোরও প্রয়োজন মনে করলোনা। বিয়েটা হয়ে গেছে। বিয়ের পর পরই দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে অবন্তি। আর যাওয়ার আগে শেষ চিঠিটা রেখে গেছে। আর নির্দেশনা অনুযায়ী সে দেশ ছাড়ার পরেই যেন চিঠিটা আর্যর হাতে পৌছায়।      

আর্য এসবের সবই জানে। যেদিন ওর টিউমার ধরা পড়ে সেদিন থেকেই জানতো ওর সময় প্রায় শেষ। কিন্তু অবন্তিকে যে কথা দিয়েছিলো সারাজীবন ওকে সুখে রাখবে। এজন্য সে তার শেষ ইচ্ছে হিসেবে তার বন্ধু ধীমানের কাছে আবদার করে বসে যেন সে অবন্তিকে বিয়ে করে। সেই হাই প্রোফাইল ছেলেটা আর কেউ নয় ধীমান। তবে আর্য এতটুকু আশা করেছিলো অবন্তি ওকে জানাবে। বিয়েতেও রাজী হবেনা। কারন অনেক ভালোবাসে যে অবন্তি ওকে। তাই অবন্তির জন্য একটি চিঠিও লিখে রেখেছিলো আর্য। কিন্তু সেসব ভালোবাসাকে মিথ্যে করে অবন্তি আজ অন্য কারো হয়ে গেছে। তাই আর্য ধীমান কে বলেছিলো অপারেশন থিয়েটারে ঢোকার আগেই যেন সে অবন্তি কে নিয়ে দূরে চলে যায়। 

আর্যর মা বন্ড পেপারে সই করছে। আর্যকে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি চলছে। আর্য ভাঙা ভাঙা কন্ঠে বললো, "মা, আমার পকেটে একটা কাগজ আছে ওটা দাওনা।" কাগজটা হাতে নিয়ে একটি দিয়াশলাই চাইলো। কাগজটায় আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে। "এখন এসব কি করছিস, বাবা" জিজ্ঞেস করতেই আর্য বললো, "এটা আমার শেষ চিঠি, এখন আর এটার কোনো প্রয়োজন নেই অবন্তি ভালো আছে, আমি আমার কথা রাখতে পেরেছি মা।" 


আর্যকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে আর এদিকে দাউ দাউ করে জ্বলছে শেষ চিঠিটা। আর্যর চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে, মনে হচ্ছে আগুন নেভার সাথে সাথে আর্যও হারিয়ে যাচ্ছে।  

Author:
Farhana Akter Mim
Studies at Khulna University of Engineering & Technology (KUET)  
               
STORYLANDBD
STORYLANDBD

This is a short biography of the post author. Maecenas nec odio et ante tincidunt tempus donec vitae sapien ut libero venenatis faucibus nullam quis ante maecenas nec odio et ante tincidunt tempus donec.

No comments:

Post a Comment