সবসময় হাসিখুশি থাকা মানেই সুখে থাকা নয়। আপনি হয়তো একজনকে হাসতে দেখলেই পরিমাপ করে ফেলেন মানুষটা কতটা সুখী। অনেক সময় উপরওয়ালার কাছে আবদারও করে বসেন "ইশ ওর মতো যদি আমার জীবনটা হত। "
উপরওয়ালা আপনাকে যা দিয়েছেন বুঝে শুনেই দিয়েছেন। যতটুকু দিয়েছেন তার চেয়ে এক বিন্দু বেশিও আপনার প্রয়োজন নেই। আপনি হয়তো ওই সুখী মানুষটার হাসিটাই দেখতে পারছেন কিন্তু তার জীবন সাগরে একটিবার ডুব দিয়ে দেখুন আমি নিশ্চিত সেই সমস্যা গুলো দেখার পর আপনি আর তার মতো জীবন চাইবেননা।
এখন নিম্নবিত্ত পরিবারের আমার উপর অভিযোগ থাকতেই পারে যে, দিন আনে দিন খাওয়া মানুষ গুলো কতই না কষ্ট করে জীবন পার করে, তারা যদি কোনো উচ্চবিত্ত মানুষের জীবন ধারায় চলার স্বপ্ন দেখে সেটা ভুল কিসের?
ভুল কিছুই না। প্রত্যেক টা মানুষেরই স্বপ্ন দেখার অধিকার রয়েছে। কাউকে আদর্শ মেনে কঠোর পরিশ্রম করে, নিজেকে সেই স্থানে নিয়ে যেতে পারাটা সত্যিই প্রশংসনীয়। কিন্তু এক ধরনের মানুষ আছে যারা বিনা পরিশ্রমে একরাশ হাহাকার নিয়ে আরেকজন কে দেখে শুধু আফসোসটাই করতে পারে। এতে লাভ তো কিছু হয়ই না বরং জীবনের অতি মুল্যবান সময় টুকুও এসব ভাবতে ভাবতেই পার করে ফেলে। কিন্তু ওই আফসোসের বদলে মানুষটা যদি কঠোর পরিশ্রম করতো তাহলে যাকে দেখে এতো হাহাকার তার চেয়েও অনেক উন্নতি করা সম্ভব ছিলো। কিন্তু আমরা জাতি হিসেবে অনেক অলস। আমাদের জন্য পরিশ্রম করে জীবনে উন্নতি করার চেয়ে আরেকজনকে দেখে আফসোস করাটা বেশি সহজতম।
আমি সেই ধরে এতো ভাষন কেন দিচ্ছি সেটাই ভাবছেন তো? তাহলে চলুন আপনাকে একটু আমার কল্পনা রাজ্য থেকে ঘুরিয়ে নিয়ে আসি। আমি শুধু আমার উপলব্ধি করার বিষয়টুকুই আপনাদের সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করছি।
ছোটবেলায় আমিও যে কতবার কতজন কে দেখে ভেবেছি, ওর মত জীবন যদি হতো। কত্ত ভালোই না থাকতাম। এরকম একটা জীবন থাকলে আর কি দরকার হয়।
আমার একটা বান্ধুবি ছিলো, অনেক উচ্চবিত্ত পরিবারের মেয়ে সে। স্কুল, কোচিং, ওঠা-বসা ওর সাথেই ছিলো। সে সুবাদে ওর জীবনযাত্রা খুব কাছ থেকে দেখা। ওকে দেখে মাঝে মধ্যে আফসোস আমারো হতো। আমি মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে হয়ায় সেসব কিছুর সুযোগ পেতাম না যা কিছুর সুযোগ ও পেতো।
আমি প্রচণ্ড কল্পনাপ্রিয়। আমার ইচ্ছে গুলো নিয়ে স্বপ্ন দেখতে খুব ভালো লাগে। মাঝে মধ্যে নিজেকে ওর যায়গাতে ভাবতাম। একদিন আন্টি (বান্ধুবীর আম্মু) আমার আম্মুর সাথে গল্প করার সুবাদে জানতে পারলাম, ওর জন্মের আগে আংকেল কখনই সন্তান নিতে চাননি কারন তার নাকি বাচ্চা পছন্দ না। এমনকি ওর জন্মের পর মাসখানিক আংকেল ওকে কোলেও নেননি। ও বড় হওয়া অব্দি ওকে এড়িয়ে চলেছেন আংকেল।
বাবার হাত ধরে মেয়েটা হাটতে শেখেনি। বাবার কোলে উঠে কখনও বায়না করার সুযোগ হয়নি মেয়েটার। বাবাকে ঘোড়া বানিয়ে সেই ঘোড়ার পিঠে চড়ে পুরো বাড়ি চক্করটাও হয়তো কাটা হয়ে ওঠেনি কখনও। এদিকে আমার বাবা উচ্চবিত্ত নয় তো কি হয়েছে, কোনোদিনও কোনো ইচ্ছে অপূর্ণ রাখেনি। যখন না বায়না করেছি সব হাজির। আম্মুর কাছ থেকে শোনা, যখন আমার জন্ম হয়, মেয়ে হয়েছে শুনে আমার বাবা আনন্দে কেদে ফেলেছিলো। আশেপাশের মানুষ যখন ছেলে হয়নি শুনে সান্তনা দিতে এসেছিলো তখন আমার বাবা আনন্দে উচ্ছাসিত হয়ে তাদের কে মিষ্টি মুখ করিয়েছে।
এবার কিছুক্ষণের জন্য ধরে নেয়া যাক আমি আমার বান্ধুবির জায়গায় আছি। তাহলে? তাহলে বাবার এই ভালোবাসা টুকু কি আমার ভাগ্যে থাকতো? কিছু অতিরিক্ত সুযোগ সুবিধা কি বাবার ভালোবাসাটার পরিপূরক হতে পারে? কখনোই না। বরং সুযোগ সুবিধা যতটুকু আছে খুব ভালোই কেটে যাচ্ছে দিন। আর রইলো উচ্চ আকাঙ্খাগুলোর কথা আমি নিজের জায়গা থেকে যদি পরিশ্রম করি তাহলে এক সময় সে সামর্থ্য টুকু নিজেই অর্জন করতে পারবো।
ভাগ্যের জেরে ভালোবাসা আর পরিশ্রমে সাফল্য দুটোই আমার।
আরেকটি ঘটনা বলি। বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তির সময় আমার অনেক বন্ধু- বান্ধবরা অনেক নামি দামী শিক্ষকদের শরনাপন্ন হয়েছে। তাদের কাছে পড়েই নাকি অনেকে দেশের সনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়েছে। তাই সবাই ছুটেছে তাদের পেছনে। কিন্তু এমন কিছু শিক্ষক ছিলেন যাদের কাছে পড়ার সামর্থ আমার ছিলোনা। তাই আমার আর তাদের কাছে পড়া হয়নি। কিন্তু আমার বাবা-মা দুজনেই তাদের সামর্থেরও অনেক বেশি দিয়ে আমাকে পড়িয়েছেন। যখন যেটা দরকার ছিলো সবকিছুই তারা তাদের সাধ্যের বাইরে গিয়ে আমাকে দিয়েছেন। এর চেয়ে বড় আশীর্বাদ আর কি হতে পারে। মেয়ে মানুষ এতো পড়ালেখা করিয়ে কি হবে? সবার এই বাণী উপেক্ষা করে দুজনেই সাপোর্ট করে গেছেন আমাকে। তাদের ভালোবাসা, বিশ্বাস আর আমার নিজের পরিশ্রমে আজ দেশের সনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার সুযোগ হয়েছে। কিন্তু নামি দামী শিক্ষকদের পেছনে ছোটা অনেকেই এখন টাকার জেরে বেসকারি তে পড়াশোনা করছে।
জীবনে ভালো খারাপ দুটোই থাকে। এরা একে অন্যের পরিপূরক। কেউ হাসছে মানেই এই না যে সে অনেক সুখী আবার কেউ কাদছে মানেও এই না যে সে দুঃখী। জীবনে যেসবের কমতি রয়েছে সেগুলো পরিশ্রম দিয়েই পূরণ করা সম্ভব। আর কে কতটুকু ভালো আছে সেটা নির্ভর করে যার যার চিন্তাভাবনা আর বাস্তবতা কে মেনে নেয়ার ওপর। খারাপের মধ্যেও ভালোটাকে যেদিন খুজে নিতে পারবেন তখনই প্রকৃত সুখ অনুভব করতে পারবেন। সেদিন আপনার অভাবের আক্ষেপটা ভাল থাকার পরিপূরকে পরিণত হবে।
Author:
Farhana Akter Mim
No comments:
Post a Comment