আমরা ৭জন | we are seven



ইউনিভার্সিটিতে এসে এখনো কোনো ট্রিপে যাওয়া হয়নি...ক্লাস,ল্যাব, সিটি এসবে অতিষ্ঠ হয়ে ক্যাফেটেরিয়ায় বসে আছি…. ক্লান্ত শরীর,বিরক্ত মনে গিটার হাতে বেসুরা স্বর তোলার প্রচেষ্টা চলছে…গলা দিয়ে কারোরই সুর বের হচ্ছেনা….মনে হচ্ছে পুরো পৃথিবীতে আমরা আর আমাদের বিরক্তিতা ছাড়া আর কোনো কিছুরই অস্তিত্ব নেই… হঠাৎ করে অঙ্কন এলো, " কিরে আতেল কি অবস্থা? সবার মুড অফ কেন?"  তন্দ্রা আরো একরাশ বিরক্তি নিয়ে বলল,  "পড়ালেখা নিয়ে যদি এখন কোনো কথা বলস,তাহলে থাপড়ায়ে সব দাঁত ফেলে দেব। 

" অঙ্কন অনেক হাস্যরসিক মানুষ হওয়াতে আমাদের সব মন মেজাজ খারাপের সমাধান তার কাছে থাকে। হঠাৎ করে অঙ্কন বলে উঠল, " মামা, পরশু থেকেতো উইকেন্ড সাথে আর একদিন ক্লাস অটো নিয়ে চল সিলেট ট্যুর দিয়ে আসি, পড়ালেখা হাবিজাবি আর ভাল্লাগতেছেনা। "  আমি ওকে বললাম, " হ্যাঁ, একদিনের মাঝে এতগুলা টাকাতো তুই দিবি.... "  প্রতিবারের মত এবারও ওর কথার কোনো গুরুত্ব দিলামনা আমরা। ২ মিনিট পরে পান্থ এর কি জানি হল কে জানে, সে জোরে চিৎকার দিয়ে বলে উঠল," মামা, চল যাই।"   তন্দ্রা বলল," হুট করে একটু পরপর কি হয় তোদের! এমনিতেই মাসের শেষ, হাতে কোনো টাকাপয়সা নাই, আর তোরা এখন বলতেসিস সিলেট যাওয়ার কথা তাও আবার একদিনের মাঝে! "  
Tea Garden Sylhet 

তখন পান্থ অনেক উচ্ছ্বাসিত হয়ে বলল," আরে ওইজন্যইতো খুশি হচ্ছি,সবাই মোবাইল এর ম্যাসেজ চেক কর।"  আমরা সবাই ফোন হাতে নিয়ে দেখি অ্যাকাউন্টে বৃত্তির টাকা চলে আসছে। আমরা অত্যন্ত প্রফুল্ল হয়েএকজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে বললাম চল যাই তাহলে। মুহূর্তেই যেন সব বিরক্তি,ক্লান্তি দূর হয়ে গেল।  ভাবতেই অবাক লাগছে যে সাডেন একটা প্ল্যানে কিভাবে সবাই এত সিরিয়াস হয়ে গেলাম আর কিভাবেই বা সবাই এই মুহূর্তেই একসাথে টাকাটা পেয়ে যাওয়ার মত মিরাকেল ঘটে গেল !

তারপর যেই কথা সেই কাজ।  সবাই রুমে গিয়ে প্যাকিং শুরু করলাম। আজ রাতেই রওয়ানা হব। সকালে পৌঁছাব, তারপর ২ দিন থাকব, ৩ দিনের দিনে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিব। 

রাত ১০টার বাসে উঠলাম।  অনেক অল্প সময়ের মাঝে রওয়ানা হওয়াই খুব বেশি প্রস্তুতি নিতে পারিনি। আমরা ৭ জন.... লিমন প্রথমে একটু না না করছিল, তারপরে তাকে জোর করে নিয়ে আসলাম।  রাতের আঁধারে প্রকৃতি দেখা হয়নি। অনেকক্ষণ পর্যন্ত বাসেই গান,গিটার,বিট বক্সিং আড্ডা চলল আমাদের। তারপর রাত গভীর হওয়ার সাথেসাথে একে একে সবাই ঘুমিয়ে পরলাম। সবাই যখন গভীর ঘুমে মগ্ন, হঠাৎ করেই আমার ঘুম ভাঙলো,তাকিয়ে দেখি ভোর হয়ে গেছে। আশেপাশে কুয়াশা,তার একটু ফাঁকেফাঁকে ছোট ছোট টিলা দেখা যাচ্ছে। 

গাড়িও বেশ আঁকাবাঁকা ভাবে চলছে। আমি আনন্দ ধরে রাখতে না পেরে পৃথীকে ডাকলাম," এই পৃ, উঠ দেখ আমরা প্রায় চলে আসছি। " ডাকতেছিলাম শুধু পৃথীকে কিন্তু আমার চিল্লাপাল্লায় সবাই এক এক করে উঠে পরলো। তারপর যে যার পাশের জানালা দিয়ে প্রকৃতির অদ্ভুত সৌন্দর্য উপভোগ করতে থাকলাম।  কুয়াশাজড়ানো প্রকৃতি,মিষ্টি রোদ মেঘের আড়াল থেকে উঁকি দিচ্ছে। আস্তে আস্তে কুয়াশা কেটে যেতে লাগল আর আমরা দূর-দূরান্তের টিলাগুলো একদম স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম। ভোর ৭টায় আমরা সিলেট শহরে পৌঁছালাম।

 বাস থেকে নেমেই একটা অটো নিয়ে সোজা হোটেলে চলে গেলাম, আসার সময়ই হোটেল বুক করে এসেছিলাম। রুম নিলাম ৩টা।  তারপর যে যার রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে হোটেলে একসাথে ব্রেকফাস্ট করে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলাম। প্ল্যান করলাম সবাই ১১টায় বের হব। এদিকে আমাদের ফটোগ্রাফার বন্ধু, পোদ্দার, গুগল ম্যাপ খুজে সব ডেস্টিনেশন ফিক্স করে ফেলেছে। ১১টায় আমরা ৭জন হোটেল থেকে বের হলাম। 

প্রথম ডেস্টিনেশনঃ  লাউয়াছড়া। সিলেট শহরে অটো নিয়ে ঘুরাটা অনেক স্বস্তিকর। প্রায় ৪৫ মিনিট পর আমরা লাউয়াছড়া পৌঁছালাম। আশেপাশে তাকিয়ে খুবই অবাক হচ্ছিলাম। কারণ একই জায়গায় দাঁড়িয়ে দুইপাশে দুইটা ভিন্ন দৃশ্য দেখতে পাচ্ছিলাম! একপাশে চা বাগান যা ছোটছোট টিলার আকারে অবস্থান করছে, সাথে গাছগাছালি সহ সবুজ-শ্যামল অরণ্য ; আরেক পাশে ছোটছোট পাহাড় আর পাহাড়ের চূড়ায় যেন আকাশ এসে মিশে গেছে। আগে আমরা পাহাড়ে উঠা শুরু করলাম । পাহাড়ে অর্ধেক উঠার পর নিচে তাকিয়ে দেখি ভালই উপরে উঠে এসেছি। আমার আবার হাইট-ফোবিয়া, নিচে তাকাতেই একটু একটু ভয় লাগা শুরু করলো। 

মোটিভেশনাল স্পিকার তন্দ্রা বলল," আরে ধুর নিচে তাকাইস না, উপরে তাকা আর দেখ এইটুকু পথ যেতে পারলেই পুরো সিলেটটাকে একনজরে দেখতে পারবি। তাছাড়া উপরে তর ছবিও সুন্দর আসবে, তারপর তুই ফেসবুকে ডিপিও চেঞ্জ করতে পারবি।" ওর কথায় আমি আরো খুশি হয়ে  উপরে উঠতে থাকলাম। কিছুক্ষণ পর কাঙ্খিত সেই চূড়ায় পৌঁছালাম। আশেপাশের সব পাহাড়গুলোর মাঝে ওই পাহাড়টাই সবচেয়ে বড় ছিল যেটাতে আমরা উঠেছিলাম।আর পাহাড়ে উঠার পর যা দেখলাম নিজ চোখে, তা ভাষায় প্রকাশ করার মতনা।

 দূর-দূরান্তে যতদূর চোখ গেছে শুধু পাহাড় আর মাঝখান দিয়ে চলে গেছে আঁকাবাঁকা রাস্তা। অন্যপাশে কিছুকিছু ছোট পুকুর দেখা যাচ্ছিল, আর অসংখ্য চা বাগান দেখে মনে হচ্ছে সব যেন ঢালু হয়ে মাটিতে মিশে গেছে। আমাদের ফটো কুইন লিমন এদিকে সেলফি তোলায় ব্যস্ত। সবাই মিলে অনেক ছবি তুললাম,প্রকৃতি উপভোগ করলাম। ওইখানে একটা ছোট চায়ের টং ছিল, টং এর মালিক এর নাম আকবর চাচা। সবাই মিলে সিলেটের বিখ্যাত সাত রঙয়ের চা খেলাম। চায়ের টং এ বসে আকবর চাচার সাথে পরিচিত হলাম, অনেকক্ষণ আড্ডা দিলাম, অসম্ভব ভাল একজন মানুষ উনি, মনেহচ্ছে সবাইকে আতিথ্যেয়তার সাথে সাদরে গ্রহণ করার জন্যই উনি এখানে বসে আছেন। 

তারপর পাহাড় থেকে নামার সময় হল। নামতে গিয়ে পড়লাম বিপদে,নিচে তাকাতেই ভয় লাগছে আমার,নামব কিভাবে! পান্থ বলল," এক কাজ কর, আমার হাত ধর। " কিন্তু আমি ভাবলাম ওর হাত ধরার পর যদি আমি পড়ে যাই তাহলেতো ও পড়বে আমার সাথে আর পাহাড় যথেষ্ট উঁচু। তাও কোনোরকম এক পা দুপা করে অনেক ভালভাবে নেমে আসতে পেরেছি। এবার ছিল চা-বাগান যাওয়ার পালা। পাহাড়গুলোর অপরপাশেই চা বাগান, ৭ জন মিলে ঢুকে পরলাম বাগানে।

 চায়ের টিলাগুলো অনেক সুন্দরভাবে সাজানো, এবার উঠলাম চায়ের টিলায়। ওইখান থেকে কিছু চাপাতাও ছিড়ে নিলাম। মোটামুটিভাবে চা-বাগান ঘুরা শেষে এবার ছিল আমাদের লাঞ্চ করার পালা। ওইখান থেকে হালকা কিছু খেয়ে লাউয়াছড়া ছেড়ে হোটেলের দিকে রওয়ানা দিলাম। হোটেলে গিয়ে সবাই লাঞ্চ করে হালকা ঘুমিয়ে নিলাম।


বিকাল ৫টায় বের হলাম সাস্টে ঘুরতে, সাস্টে আমার ছোটবেলার এক বান্ধবী পড়ে। ওকে বের হওয়ার আগেই ফোন দিয়েছিলাম, সাস্টের গেটে পৌঁছাতেই দেখি দিনা দাঁড়িয়ে আছে। প্রায় ১ বছর পর দেখা, দিনা থাকাতে ভার্সিটির ভেতরে হারিয়ে যাইনি। তারপর গোলচত্ত্বরে বসে আড্ডা দিলাম অনেকক্ষণ, অসম্ভব সুন্দর একটি ক্যাম্পাস। যারা এখানে পড়ে তারা কতই না ঘুরতে পারে। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় বিদায় নিলাম দিনার কাছ থেকে। আবারো হোটেলে চলে এসে ফ্রেশ হয়ে ডিনার করে হোটেলের লনে গিয়ে বসলাম সবাই একসাথে। আমাদের আড্ডার মূলমন্ত্রই হল গান। প্রকৃতি আর গান এই ২টার সংমিশ্রণে এতটাই হারিয়ে গিয়েছিলাম যে কখন যে ১২টা বেজে গেছে টেরই পাইনি। ১২টার দিকে সবাই রুমে গিয়ে ঘুমিয়ে পরলাম। 

পরদিন সকাল, আজকের স্পট হল বিছানাকান্দি, ১০টায় রওয়ানা হলাম, একঘণ্টা পর বিছানাকান্দি পৌঁছালাম। চারিদিকে ছোটছোট পাথর আর একদম চকচকে পরিষ্কার পানি। আমি পানি দেখেই দৌড় দিলাম পা ভিজাতে, এর মাঝে ঘটলো এক বিপদ, ওই ছোটছোট পাথর এত ধারালো যে পায়ে বিধে গেল। রক্ত পড়া শুরু করলো আমার পা থেকে, পৃথীর কাছে সবকিছুর অগ্রীম ব্যবস্থা থাকে,ও ওর ব্যাগ থেকে ব্যান্ডেজ বের করে লাগিয়ে দিল।  এসব একটুআকটু ব্যথাতে কি আর আমি দমে থাকার মত মানুষ! আবার ওই পা নিয়েই পানিতে নেমে পরলাম। বিছানাকান্দি ঘুরা শেষ করে গেলাম ভোলাগঞ্জ, সেখানে সাদাপাথর নামের একটা জায়গা আছে যা দেখতে অদ্ভুত সুন্দর। ছোটবড় অনেক পাথরের সমন্বয়ে জায়গাটি অসম্ভব সুন্দর। খুব বেশি গরম ছিলনা ওদিন তাই সারাদিন ঘুরতে একটুও অসুবিধে হয়নি। 

ভোলাগঞ্জ ঘোরা শেষ করতে করতে সন্ধ্যা নেমে গেল, হোটেলে ফিরে রাতে আবার বের হলাম মার্কেটে ঘুরতে। সিলেটের বিখ্যাত কিছু খাবার খেলাম,তারপর ওখানকার মার্কেট থেকে টুকিটাকি কিছু কেনাকাটা করলাম।  আমি আম্মুর জন্য একটা শাল কিনলাম, সিলেট এর শাল  অনেক বিখ্যাত। মার্কেট ঘোরা শেষের মাধ্যমে আমাদের দ্বিতীয় দিনও শেষ হল।

 তৃতীয় দিন,এটিই ছিল আমাদের সিলেটে শেষদিন। প্রতিদিনের মত সকাল সকাল বেরিয়ে গেলাম, আজ গন্তব্য মাধবকুণ্ড। মাধবকুন্ডে রয়েছে সিলেটের বিখ্যাত ঝর্ণা, ছোটবেলা থেকে এই জায়গার শুধু ছবিই দেখে এসেছি,আজ সামনাসামনি উপভোগ করার পালা। ওইখানে পৌঁছে দেখি অনেক মানুষের ভীড়,অনেক আশপাশ করে ঝরনার কাছে গেলাম,পাহাড় গড়িয়ে অজস্র পানির বিন্দু ঝরনা আকারে নিচে এসে পরছে। ঝর্নার পানিতে সবচেয়ে বেশি চুবানো হলো লিমনকে। হঠাৎ অনেক কৌতুহল হল উপরে গিয়ে দেখার, তারপর যেই কথা সেই কাজ।  পাহাড়ে উঠা শুরু করলাম, অনেক আস্তেধীরে উঠে পরলাম পাহাড়ে।  সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হিচ্ছে আমরা সবাই অ্যাডভেঞ্চার লাভার, তাই এসব কাজে সবাই এক লাফে রাজি হয়ে যাই তা পারি আর না পারি। তারপর মাধবকুন্ডের আশেপাশের আরো জায়গা ঘুরে সন্ধ্যার দিকে হোটেলে ফিরে আসলাম।

যাওয়ার সময় হয়ে গেছে.... এত সুন্দর মুহূর্তগুলো এত তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে গেল ভেবে খারাপ লাগছিল... কিন্তু লাইফে এত সুন্দর কিছু স্মৃতি জমা হয়ে গেল ভেবে ভাল লাগছিল। রাত ৮টায় হোটেল থেকে চেক আউট করলাম, হোটেল স্টাফদের ব্যবহার অনেক ভাল ছিল, তাদের বিদায় জানিয়ে রওয়ানা দিলাম নিজ ঠিকানায়....

Author:
Farhana Akter Mim 
Studies at Khulna University of Engineering & Technology (KUET)
STORYLANDBD
STORYLANDBD

This is a short biography of the post author. Maecenas nec odio et ante tincidunt tempus donec vitae sapien ut libero venenatis faucibus nullam quis ante maecenas nec odio et ante tincidunt tempus donec.

No comments:

Post a Comment