মিষ্টি। উহু খাওয়ার মিষ্টি নয়। বাবা মায়ের আদরের একমাত্র বড় মেয়ে। ছোট একটি ভাইও আছে ওর। দেখতে দেখতে অনেক বড় হয়ে গেছে মিষ্টি। বয়স তার ২১ এ পা দিয়েছে। মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম নেয়া এই মেয়েটি দেশের সনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছে। বাবা মা এখন মোটামুটি নিশ্চিত যে মেয়েকে ভালো একটা শিক্ষিত ছেলের হাতে তুলে দিতে পারবে। আশেপাশের বাসার আন্টিরা এখন তাদের সন্তান কে এই ফতোয়াই দেয় যে "মিষ্টি কে দেখ, কত্ত বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে, ওকে দেখে শেখ কিছু"। পাশের বাসার ভাবি যে কিনা দিনরাত ফোড়ন কাটতো সেও এখন মিষ্টির জন্য গর্বে গর্বিত। আবার কিছু ঘটকালি করা প্রতিবেশী পান চিবুতে চিবুতে তাদের ছেলের জন্য সম্বন্ধ নিয়েও হাজির হয়।
অথচ এই কিছুদিন আগেই তো, এই মানুষগুলোই কতনা কুপরামর্শ,কুমন্ত্রনা আর অযোক্তিক যুক্তি বিনা দাওয়াতে বাসায় এসে দিয়ে যেত। মেয়ে মানুষ, তাকে এতো পড়ালেখা করিয়ে কি হবে, কয়দিন পর তো সেই শশুর বাড়ি গিয়েই ঘুটনি নাড়াচাড়া করবে, তখনতো আর বাবা মা কে দেখবেনা আর তাছাড়া মেয়ে মানুষের বাইরে চাকরি করাও তো ঠিক না, আরো না জানি কত কি। এসব কথার ভিড়েও মিষ্টির উপর হাল ছাড়েনি ওর বাবা মা। সবসময় সর্বোচ্চ সমর্থন দিয়ে গেছেন তারা।
কিছুদিন আগের কথা মিষ্টি কলেজে পড়াকালীন একটি বিয়ের প্রস্তাব আসে। ছেলে নাকি ব্যংকে চাকরি করে। মাইনে প্রায় ৪০ হাজার। প্রস্তাব নিয়ে আসা আন্টির ভাষ্যমতে, " দেখেন ভাবি আপনাদের পারিবারিক অবস্থা তো ভালোনা, একটা মাত্র মেয়ে, আজ না হয় কাল বিয়ে তো দিতেই হবে, ছেলেদের কোনো চাহিদা নেই।" সেদিন যদি মেয়ের উপর আস্থা না রেখে বিয়েটা দিয়ে দিতো তাহলে? তাহলে হয়তো মিষ্টির জীবনের গল্পটা অনেক অন্যরকম হতো।
তবে এখন বাবা মা ছেলে দেখা শুরু করেছে। মিষ্টির নিজের কোনো পছন্দ নেই। বাবা মা যা বলবে সেটাই শিরধার্য।
আজ মিষ্টিকে পাত্র পক্ষ দেখতে এসেছে। মিষ্টিকে দেখে পাত্র পক্ষের না করার মতো কোনো কারনই নেই। নম্র-ভদ্র,শান্ত আর হাস্যজ্বল চেহারা মুহুর্তেই যে কারো মনে জায়গা করে নিতে পারে। তবে সমস্যা একটাই মিষ্টি একটু বেশিই সহজসরল। কথায় আছেনা, "বেশি সাধাসিধে হওয়া ভালোনা, মানুষ পেয়ে বসে।" তবে যাকগে বাবা মা দেখে শুনেই যেহেতু বিয়ে দিচ্ছে ভালো ছেলেই হবে। পাত্রপক্ষ মেয়ে দেখলো। বেশ পছন্দও করলো। পাত্রী পক্ষ ছেলে সম্পর্কে আশেপাশে খোঁজ নিলো। পাড়া-প্রতিবেশীর ভাষ্যমতে ছেলে নাকি হাজারে একটা। অতঃপর দুই পক্ষের সম্মতিতে বিয়ে ঠিক হলো।
বিয়ের দিন-ক্ষণও অতি তাড়াতাড়ি ঠিক করা হলো। শুভকাজে দেরি করতে নেই। বাবা মা নিজের শেষ সম্বলটুকু দিয়ে অতি ধুমধামের সহিত বিয়ে সম্পন্ন করলো। বিদায় দেবার পালা। মা তার সহজসরল মেয়েটাকে কিভাবে অন্যের সংসারে মানিয়ে নিতে হয় তা শিখিয়ে দিচ্ছে। কেউ কিছু বললে যদি খারাপও লাগে তাও মুখফুটে যেন কিছু না বলে। পাছে লোকে বলে না বসে পরিবার থেকে কিছুই শেখায়নি। হঠাৎই মিষ্টির মনে হলো, মেয়ে হলেই কি সব মানিয়ে নিতে হয়৷ যাকগে মা যেহেতু বলছে তাহলে তাই-ই হবে।
শ্বশুরবাড়িতে পদার্পন। শ্বশুর-শ্বাশুরি একদম মেয়ের মতো যত্ন করছে। আর তার স্বামীর মতো স্বামীতো হয়-ই-না। অনেক ভালোবাসে ওকে। যেমনটা মিষ্টি আগে স্বপ্ন দেখতো। তবে স্বপ্নটা ভেঙে যাবেনা তো। নাহ এটাতো বাস্তব। সম্পর্কগুলো সবসময় এমনি থাকবে। তাছাড়া কিভাবে মানিয়ে নিতে হয় মা তো তা শিখিয়েই দিয়েছে।
কিন্তু স্বপ্ন যেমন সহজ বাস্তবতা বোধহয় তেমনই কঠিন। বেশিদিন আর সেই সুখ ভাগ্যে রইলোনা। হঠাৎই যেন সবকিছু পরিবর্তন হতে থাকলো। সম্পর্কগুলো ফ্যাকাসে হয়ে যাচ্ছে। আকাশ(মিষ্টির স্বামী) ইদানিং দেরিতে বাসায় ফিরছে। কিছু জিজ্ঞেস করলেও কোনো উত্তর দেয়না। মিষ্টি ভাবছে আজ বাসায় এলে জিজ্ঞেস করতেই হবে, রোজ রাতে দেরি করে বাসায় ফেরাটা তো মেনে নেয়া যায়না।
রাত ১টা। কলিংবেল বাজলো। মিষ্টি তাড়াতাড়ি গিয়ে দরজা খুললো।
-"কোথায় ছিলে এতো রাত অব্দি? কয়টা বাজে সেই হুশ আছে?"
-"উফফ প্রতিদিন এক ঘ্যানঘ্যান ভাল্লাগেনাতো।"
-"এতোদিন কিছুই তো বলিনি। অফিসতো শেষ হয় সেই বিকেলে তাহলে প্রতিদিন এতোক্ষন থাকো কোথায়?"
-"তোমাকে উত্তর দেয়ার প্রয়োজন মনে করিনা।"
-"নাহ আজ তোমাকে জবাবদিহি করতেই হবে।"
এই কথারই তর্ক-বিতর্কে এমন এক ঘটনা ঘটে গেলো যার জন্য কখনোই প্রস্তুত ছিলোনা মিষ্টি। হ্যাঁ আকাশ মিষ্টির গায়ে হাত তুলেছে। মিষ্টি বাকরুদ্ধ। কি বলবে জানেনা সে। পরদিন সকাল বেলা। শ্বাশুড়ি ডাকছে। মেয়েটা সারারাত ঘুমায়নি। বিছানা থেকে উঠে শ্বাশুড়ির কাছে গেলো। তিনি অগ্নিমূর্ত হয়ে বললেন, "বেলা কটা হয়েছে দেখেছো বাপু। নাস্তা বানাবে কে? তোমাদের স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়ার কারনে এখন কি আমরা না খেয়ে থাকবো?" মিষ্টি এতোক্ষনে বুঝে গেছে যে কাল রাতের ঘটনার কথা উনি জানে কিন্তু তাতে তার কিছুই যায় আসেনা।
শেষের শুরুটা বোধহয় হয়ে গেছে…
ওইদিনের ঘটনাটার পুনরাবৃত্তি শুরু হলো। আকাশ এখন প্রতিদিনই দেরিতে আসে এমনকি মাতাল অবস্থায় ফেরে। বাসায় এসেই প্রচন্ড বাজে ভাষায় গালাগালি করতে থাকে। ওকে সামলাতে গেলে হুটহাট চড় থাপ্পড় ও মেরে বসে মিষ্টি কে। এসব সহ্য করতে না পেরে মিষ্টি বাপের বাড়ি যেতে চাইল কিন্তু আশ্চর্য ওর শ্বশুর শাশুড়ি ওকে যেতে দিচ্ছে না বরং তারাই ওর উপর হওয়া অমানুষিক অত্যাচারের সাক্ষী। আরেক দিনের ঘটনা, চড় থাপ্পড় গালাগালি এসব অনেক কষ্টে মেনে নেয়া গেলেও সেদিন যা করেছে তা সহ্য করা সম্ভব না। আকাশ রাস্তার একটা মেয়েকে বাড়িতে নিয়ে এসেছে। মিষ্টিকে ধাক্কা দিয়ে ঘর থেকে বের করে দিয়ে মেয়েটার কে সাথে নিয়ে দরজা বন্ধ করেছে। এতোটুকু বুঝতে আর বাকি নেই যে কি হচ্ছে। আকাশের বাবা-মাও দাঁড়িয়ে দেখছে। মিষ্টি হাউমাউ করে কাঁদছে, দরজা পেটাচ্ছে। আর এই মুহূর্তে ও শাশুড়ি এসে ওকে টেনে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে।
-" আরে বৌমা এত চিৎকার চেঁচামেচি করছ কেন?"
-"মা আপনি কিছু বলেন আপনার ছেলেকে? আপনি কিছু বলছেন না কেন? ও একটা রাস্তার মেয়ের সাথে এক ঘরে তাও আবার আমার সামনে।"
-"তোমরা আজকালকার ছেলে মেয়ে তোমরা যদি এসব বিষয় স্বাভাবিকভাবে মেনে না নিতে পারো.."
-"মা আপনি এসব কি বলছেন আমি ওর বিবাহিত স্ত্রী।"
-"তাতে কি তুমি ওর চাহিদা পূরণ করতে পারোনি দেখেইতো আজ আমার ছেলেটাকে এসব করতে হচ্ছে।"
নিজেকে অনেক বেশি অসহায় লাগছে। এগুলো মেনে নেয়া কি নির্মম যন্ত্রণা তা একমাত্র সেই বোঝে যে সহ্য করে। নিজের চিন্তাশক্তি হারিয়ে ফেলছে মিষ্টি। এভাবে আর থাকা সম্ভব না, যে করেই হোক নিজের বাসায় পৌঁছাতে হবে। কিন্তু কিভাবে? বাসা থেকে বের হওয়ার রাস্তা বন্ধ করে রেখেছে। আরো কিছুদিন এভাবে চলল। একদিন হঠাৎ করে মিষ্টির ভাই ওদের বাড়িতে গেলো। বিয়ের পর একবারমাত্র নিজের বাড়িতে গিয়েছিলো। বাবা-মার খুব দেখতে ইচ্ছা করছে তাই নিতে এসেছে। অনিচ্ছাসত্তেও ওরা মিষ্টিকে আসতে দিতে বাধ্য হয়েছে।
আজ অনেকদিন পর মিষ্টি বাইরে বেরিয়েছে। মনে হচ্ছে প্রাণ খুলে নিঃশ্বাস নিতে পারছে। বন্দিজীবন কতটা বেদনাদায়ক সেটা শুধু একজন বন্দী মানুষই জানে। বাড়িতে পৌঁছালো। মিষ্টিকে দেখামাত্রই বাবা-মা দুজনেরই চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। তাদের কোমলমতি মেয়েটার একি অবস্থা। চোখের নিচে কালো দাগ, রোগাটে শরীর, হাত পা ঠোঁটে রক্ত জমাট বেঁধে কালশিটে পড়ে গেছে, পুরো শরীরে আঘাতের চিহ্ন। পুরো পশুর মতো আচরণ করেছে। বাবা মাকে কাদতে দেখে মিষ্টিও কান্নায় ভেঙে পড়েছে।
-"বাবা আমি আর ওখানে ফেরত যাবোনা।"
মেয়ের এই অবস্থা দেখে বাবা-মা যেন নিজেদের ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। অসহায় বাবা মেয়ের মাথায় হাত রেখে বললেন, "তোকে আর যেতে হবেনা মা।" কিছুদিন পর্যন্ত মিষ্টি কিছুটা ভারসাম্যহীন ছিল। আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হয়েছে। এদিকে ও বাড়ি থেকে ফোন দিয়েছে,"বেয়াই সাহেব অনেকদিন তো বৌমা বাপের বাড়িতে থাকলো এবার পাঠিয়ে দিন।"
-"কেন যাতে এবার আমার মেয়েটাকে একদম মেরেই ফেলতে পারেন?"
-"ওমা সে কি কথা। ও কি আমাদের মেয়ে নয়। আর স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে একটু ঝগড়াঝাটি হয়ই তাই বলে সম্পর্কটাতো আর শেষ করে দেয়া যায়না।"
-"এটাকে সম্পর্ক বলে? আমার সহজসরল মেয়েটাকে ব্যবহার করেছেন নিজেদের ছেলের চরিত্র ঢাকতে।"
-"এসব কি বলছেন, আমি বুঝলাম না মিষ্টি আপনাদের কি বলেছে, আর সব না জেনে আমাদের ছেলে সম্পর্কে বাজে কথা বলবেন না।"
-"হ্যা, আপনাদের ছেলেতো একদম ধোঁয়া তুলসি পাতা। যাইহোক কথায় কথা বাড়ে। দিনশেষে সব ঝামেলা আমাদের পোহাতে হবে কারণ আমরা মেয়ের পক্ষ। তাই সোজাসাপ্টা বলে দিচ্ছি মেয়ে আমরা আর পাঠাবো না। ডিভোর্স পেপার সাইন করে পাঠিয়ে দেব। বাকিটা আমাদের উকিলের সাথে কথা বলে নেবেন।"
-" মানে কি ফাইজলামি পাইছেন নাকি সেই ধরে ভদ্র ভাষায় কথা বলতেছি দেখে কি কথা গায়ে লাগাচ্ছেন না।"
-"আপনাদের মত মানুষের সাথে এখনো যে কথা বলছি আপনাদের সৌভাগ্য।"
-"আপনি জানেন আমি আপনাদের নামে কেস করতে পারি।"
-"যান করেন। আমিও দেখি আপনারা কতদূর যেতে পারেন কিন্তু মেয়ে তো আমরা কিছুতেই পাঠাবো না। এবার যা পারেন করেন।"
ফোনটা কেটে দিয়েছে। এরপরেও অবশ্য কয়েকবার ফোন দিয়ে ধমকানোর চেষ্টা করেছে ওরা। ওরা অনেক চেষ্টা করেও দমাতে পারেনি। মিষ্টির বাবাকে অনেকেই বলেছে ওদের নামে কেইস করতে কিন্তু তার কথা, "আমি আমার মেয়ে টাকে জীবিত ফেরত পেয়েছি এই অনেক।"
অবশেষে ডিভোর্সের মাধ্যমে সম্পর্কটা ইতি টানে।
এবার আসে সেই দল লোক যারা সান্তনার নামে শুধু ফোড়ন কাটতেই জানে। আমাদের সমাজে একজন ডিভোর্সির সুস্থভাবে বেঁচে থাকাটা দায়। যতোটুকু না সে নিজের জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো নিয়ে কষ্টে থাকে তার চেয়ে বেশি যন্ত্রণা দেয় আশেপাশের মানুষগুলো। আমরা শুধু মেয়ে সন্তানদের এটাই শেখাই কিভাবে কম্প্রোমাইজ করতে হয়। ছেলেদের কখনো এটা শেখাইনা কিভাবে কম্প্রোমাইজ গুলোকে রেস্পেক্ট করতে হয। আশেপাশের মানুষ কি বলবে, সমাজে কিভাবে চলবে এই চিন্তাগুলো জীবনের শিকল হয়ে দাঁড়ায়। এগুলোই সামনে এগিয়ে যেতে দেয়না। কিন্তু মিষ্টির বাবা মা আশেপাশের মানুষগুলোর একদম পরোয়া করেনি। একবারের জন্যেও বলেনি ও বাড়িতে ফিরে যেতে। এখন মিষ্টি খুব ভালো আছে। পড়ালেখা শেষ করে একটা সরকারী চাকরি করছে। আপাতত বিয়ের চিন্তা মাথায় নেই। তবে ওর বিশ্বাস একসময় কেউ ওকে অনেক ভালোবাসবে। সেই ভালোবাসার অপেক্ষাতেই আছে।
বি.দ্র: গল্পটি সত্য ঘটনা অবলম্বনে লেখা। এখান থেকে কিছু বিষয় শিক্ষা নেয়ার আছে,
-আশেপাশের মানুষের কথা খুব বেশি কানে নিতে নেই কারন দিন শেষে নিজের সুখ, দুঃখ, সমস্যা সব নিজেরই। কেউ বিপদে এগিয়ে আসবেনা।
-জীবনে যতই ঝড় ঝাপটা আসুক না কেন নিজের পরিবারই সেই শক্তি যা আমাদের সমস্যা সমাধানের শক্তি জোগায়।
-বাবা মার পছন্দে বিয়ে করলেই জীবনে সুখী হওয়া যায় কথাটা ভুল কারন দিন শেষে ভালো থাকাটা ভাগ্যের উপর নির্ভর করে।
-কম্প্রোমাইজ শব্দটার উপর এতো গুরুত্ব না দিয়ে আত্মসম্মান কে বেশি প্রাধান্য দেয়া উচিত কারন যেখানে সম্মানই নেই সেখানে মানিয়ে নেয়ার প্রশ্নই আসেনা।
Author:
Farhana Akter Mim
Studies at Khulna University of Engineering & Technology
No comments:
Post a Comment