গ্রামীণ হিরো...



"জিতু ও জিতু বাড়ি আছো নাকি?" 
চিৎকার করতে করতে বাড়ি প্রায় মাথায় তুলে কীর্তনীয়া নিরঞ্জন এসে বাড়ি ঢুকল। বাড়ি বলতে ওই দুইটা কোনোভাবে দাঁড়ানো ভাঙা ঘর আর কোণায় একটা খোলা রান্নাঘর। চিৎকার শুনে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো জিতুর দ্বিতীয় পক্ষের বউ আনিকা। এমন শ্রীময়ী চেহারা আর এমন ব্যক্তিত্বসম্পন্না মহিলা এই ভবঘুরে নিরঞ্জন গ্রামাঞ্চলে খুব কমই দেখেছে। এই যে জিতুর সাথে আনিকার বিয়েটা এটাও তো কম বিস্ময়কর ব্যাপার না।

"উনি তো বাড়ি নেই। কিছু বলার থাকলে আমার কাছে বলে যেতে পারেন। আর নয়তো বসেন ঘন্টাখানেকের মাঝে এসে যাবেন বাজারের দিকেই গিয়েছেন।"- আনিকা চেয়ারটা এগিয়ে দিতে দিতে বললো।
নিরঞ্জন চেয়ারটা টান দিয়ে বারান্দায় বসে বললো -"হ্যা বসেই থাকি আমারই বা আর কি কাজ। তার থেকে ভালো বৌমা তোমার সাথে বসে দুটো কথা বলি।" 

"আমার সাথে আর কি কথা...... " আনিকাও বসতে বসতে উত্তর দিল আর মনে মনে ভাবলো বলাই যায় দুটি কথা সারাদিন তো মুখে কুলুপ এটে বসেই থাকতে হয়। বড় বউ সারাদিনে কোনো কাজ করতেও দেয় না আর কথাও বলে না তেমন। এখন মনে হয় পুকুরের দিকে গিয়েছে  কাপড়চোপড় নিয়ে।

আর ওদিকে নিরঞ্জন তো এসেছেই আনিকার পেটের কথা বের করতে। সে ভালো করেই জানতো এই সময় জিতুকে বাড়ি পাওয়া যাবে না। আসলে সে দেখেই এসেছে জিতুকে বাজারের দিকে যেতে। গ্রামের কেউই জিতুর বিয়ের ব্যাপারটা সম্পর্কে এতো ভালো জানে না আর গ্রামের মানুষের কাজ হচ্ছে কোনো অজানা বিষয় থাকলে সেটাকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে একটা বৃহদাকার কিছু বানিয়ে ফেলা।

 নিরঞ্জন কীর্তনের মানুষ ঘুরে ঘুরে কীর্তন গেয়ে বেড়ায়। বাড়িতে থাকাই হয় না তার। বাড়ি এসেছে থেকেই নিরঞ্জন আনিকার নামে অনেক গালগপ্পো শুনেছে। ঘুরে ঘুরে তার চুল পেকেছে সাথে চোখও পেকেছে অভিজ্ঞতা তো আর কম হয় নি, মানুষও তো আর কম দেখে নি এই জীবনে। তাই আনিকাকে দূর থেকে দেখেই যা বুঝেছে আনিকা বেশ ভদ্র ঘরের ভালো মেয়ে। যদিউ গালগপ্পো গুলা জিতুর সাথে বেশ ভাল ভাবেই যায়। কারন ও খুব ভালো ছেলে না ওর দ্বারা দ্বিতীয় বিয়ে করা কোনো বিস্ময়কর ব্যাপার না। 

"তা মা জিতু তো ঢাকা গিয়েছিল রোজগারের ধান্ধায় ওর সাথে তোমার দেখা হল কি করে বিয়েটাই বা হল কি করে? তোমার চালচলন দেখে যা বুঝি তোমার বাবা-মার তো জিতুর মতো ছেলের সাথে বিয়ে দেওয়ার কথা না।" নিরঞ্জন গল্পের ছলে ছলে কথাটা বললো বাকি কথাটা আদায় করার আশায়। বলে আবার ভাবছে শহুরে মেয়ে মুখ থেকে কি আর কথা বের করবে...

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে কি যেন ভাবলো আনিকা। চুপ করে বসে থেকে বললো, " কপালের ফের আরকি।" তারপর উঠতে উঠতে বললো "বসেন আপনার জন্য একটু চা মুড়ি নিয়ে আসি। " আনিকার মুখ দেখে নিরঞ্জন বুঝলো এই মেয়ে বলবে সবকিছুই শুধু বলার মতো ভরসা পাচ্ছে না। একটু ভরসার আভাস পেলেই গড় গড় করে সব বলে দিবে। "ভরসা দিতে আরকি।" মনে মনে ভেবে মুচকি হাসলো প্রবীণ কীর্তনীয়া।

একটুপরেই একটি কাপে লাল চা আর বাটিতে মুড়ি নিয়ে এসে বসলো আনিকা। আনিকার পিছন পিছন এসেছে জিতুর প্রথম পক্ষের ছোট মেয়েটা হাতে পানির গ্লাস নিয়ে। 

নিরঞ্জন মুড়ি চিবুতে চিবুতে বললো, "মাগো তোমার বাবা-মা কি করে?" আনিকা আস্তে আস্তে বললো "বাবা -মা দুইজনেই শিক্ষকতা করে মা স্কুলের বাবা ভার্সিটির।" তারপর কিছুক্ষণ নীরব বসে রইল দুইজনই। এবার নীরবতা ভাঙল আনিকাই,"আপনি আমার পুরো কাহিনীটা জানতে চাইছেন তাইতো? শুনুন তাহলে আসলে কারো না কারো জানাই উচিত। " বলে একটু নড়েচড়ে বসলো আনিকা।

"আমি ছিলাম ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ইন্টার্ন স্টুডেন্ট।  সেমি ডাক্তার ছিলাম, নিজের স্বপ্নের প্রায় দারপ্রান্তেই ছিলাম।" একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার শুরু করলো, "আমরা দুই ভাই-বোন। ছোট ভাই এইবার এইস এস সি পরীক্ষা দিল কেমন বা হল পরীক্ষা খবর তো জানি না। আমাদের বাসা চিটাগাং আমি ঢাকা হলে থেকে পড়াশোনা করতাম। নিজের হাতখরচ চালানোর জন্য একটা টিউশন করাতাম। 


ওই দিন ডিউটি শেষে টিউশন করিয়ে হলে না ফিরে আমার এক ফুফুর বাসা আছে তার ওখানে যাচ্ছিলাম। জ্যামের কারণে একটু রাত হয়ে গিয়েছিল। ঢাকা শহরে রাত যদিউ বেশী কিছুনা। কিন্তু ওই এলাকাটা মোটামুটি নীরব। আর শয়তানদের কিবা দিন কিবা রাত। আমি যখন রাস্তায় হাটছিলাম তখনি কয়েকটা ছেলে আমার পিছন পিছন আসছিলো আমি তেমন ভাবে পাত্তা দেই নি রাস্তায় তো মানুষ হাটবেই। কিন্তু আমি যখনি গলির ভিতর ঢুকলাম সেই চার পাঁচটা ছেলে আমি কিছু বুঝার আগেই আমার উপর ছেলে গুলা ঝাঁপিয়ে পড়লো।

 আমার মুখে হাত চাপা দিয়ে আমাকে গলির আরো ভিতরে নিয়ে গেল। তারপর আমার সাথে কি হয়েছে আমি কিছুই জানি না। যখন আমার জ্ঞান ফিরলো আমি দেখলাম আমি একটা কেমন যেন একটা ঝুপড়ী ঘরে শুয়ে রয়েছি। আমি তাড়াহুড়ো করে উঠতে গিয়ে দেখলাম আমার সারা শরীরে ব্যথা আমার শরীরের উপর দিয়ে যেন কী ঝড় বয়ে গিয়েছে। তারপর আস্তে আস্তে আমার সব কিছু মনে পড়লো। আমার মনে হচ্ছিল চারপাশে যা দেখছি তা কিছু সত্যি না কারন আমি শুয়ে আছি ঝুপড়ী ঘরের একটা শক্ত বিছানায় আশেপাশে আসবাবপত্র বলতে একটা শুধু টেবিল তার উপর আছে রান্নার জিনিসপাতি আরেকটা দড়ি টানানো ঘরের একপাশে তার উপর ছেলেদের কিছু কাপড়। 

আমার নিজের দিকে তাকিয়ে দেখলাম আমার পড়নে ছেলেদের শার্ট প্যান্ট। আমি বুঝলাম কেউ আমাকে রাস্তা থেকে তুলে ঘরে নিয়ে এসেছে। মনের মাঝে একিসাথে কেমন যেন একটা ভরসার ভাব আবার কেমন যেন একটা অজানা ভয় আঁকড়ে ধরে আছে। কোনোভাবে উঠে গিয়ে দরজা ধাক্কা দিয়ে দেখলাম দরজা লাগানো। আবার ফিরে এসে টেবিলের উপর রাখা পানির বোতল থেকে একটু পানি খেয়ে আরো প্রায় এক ঘন্টার মতো বসে ছিলাম।" 


এতক্ষণ কথা বলে আনিকার যেন সত্যি সত্যি পানি পিপাসা পেয়ে গেল নিরঞ্জনের জন্য আনা পানিই ঢকঢক করে গিলে ফেললো। পানি খেয়ে একটুক্ষণ বসে থেকে আবার শুরু করলো, "হঠাৎ করেই দরজাটা খুলে গেলো ঘরে ঢুকল কেমন যেন চেহারার একটা লোক। আমি ভয় পেয়ে গেলাম। 

লোকটা আমার দিকে তকিয়ে বলল, 'ঘুম থেকে জেগে গেছেন?  মাফ করবেন আমাকে বাধ্য হয়েই আপনার কাপড় বদলিয়ে দিতে হয়েছে। আমি রাতে বাসায় আসার সময় দেখলাম আপনি রাস্তার মাঝে পড়ে আছেন আমি আপনার অবস্থা দেখে বুঝলাম আপনাকে ওখানে ফেলে রেখে আসাটা ঠিক হবে না তাই কোনোভাবে আপনাকে এখানে নিয়ে এসেছি। 

এখন আপনার জন্য খাবার আর কাপড় এনেছি খেয়ে কাপড় পড়ে আপনার বাসায় যান।' আমার তখন কি হয়েছিলো আমি জানি না আমি হুট করেই ঝড়ঝড় করে কেঁদে ফেললাম। আমি মুখ ঢেকে কাঁদতে কাঁদতে বারবার শুধু একটা কথাই বলছিলাম আমি কোথাও যাব না আমি কি করে সবার সামনে মুখ দেখাব। এভাবে কতক্ষণ কেঁদেছিলাম আমি জানি না। তারপর খাওয়াদাওয়া করে আমি ওইখানেই ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম আবার।তারপর আরেকবার উঠে দেখি চারপাশে সবকিছু গোছানো হয়ে গিয়েছে ঘরের মাঝখানে একটা বড় ব্যাগ রেডি হয়ে পড়ে আছে আর ওই লোকটাও রেডি হয়ে বসে আছে। 

আমি ভয় পেলাম কারণ এমন কাহিনী শুনেছি যে মেয়েদের বিক্রি করে দেয়। আমি উঠে বসতেই লোকটা বললো, 'আচ্ছা শুনেন আপনি ঘুমাচ্ছিলেন দেখে আপনাকে না জিজ্ঞেস করেই আমি একটা সিদ্ধান্ত নিলাম আপনি আমার সাথে আমার গ্রামের বাড়ি চলেন। আপনার কোনো আপত্তি না থাকলে আপনি আমাকে বিয়েও করতে পারেন। ও ভালো কথা আমার নাম জিতু হাসান।  আমার পরিবারে আছে আমার বউ আর দুইটা মেয়ে। আমি গরীব কিন্তু কিন্তু তিনবেলা দুইমুঠো ভাত দিতে পারব।' 

আমাকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়েই একটানা কথা বলে গেলো জিতু প্রথম দিকে উনার সাথে যাওয়ার কথা শুনে ভয় লাগতে থাকলেও পড়ে সাহস নিয়ে বললাম আমি আপনাকে চিনি না জানি না আপনার সাথে কেন যাব?  আর আপনিও তো আমাকে চিনেন না তার উপর কালকে রাতে আমার সাথে যা হয়ে গেলো তাতে তো......। 

 'দেখুন।' আমার কথা শেষ করার আগেই উনি বলতে শুরু করলেন, 'আমি ঢাকা শহরে এসেছি এইতো দুই তিন মাস হয়ে গেলো তেমন কোনো রোজগারের ব্যাবস্থা করতে পারি নি। তার উপর যে টাকা নিয়ে এসেছিলাম তাও প্রায় শেষ।  আর আপনার অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে আপনার কোথাও যাওয়ার তেমন জায়গা নেই। তাই আপনাকে এই কথা বললাম এছাড়া আমার কোনো উদ্দেশ্য নেই। আর আমি এতো বড়লোক কোনো মানুষ না যে সেধে সেধে আরেকজনকে আমার ঘাড়ে নিতে যাব।'

আমি দেখলাম লোকটা রেগে যাচ্ছে তাই আমি আমার পরিচয়টা তাড়াতাড়ি বললাম আর বললাম আপনার আমাকে কিছুদিন আশ্রয় দিতে হবে। তারপর আমি আমার পড়াশোনা চালিয়ে যাব আর নিজের খরচ আমি নিজেই চালাতে পারবো।"

কথা শেষ করে আনিকা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল," এভাবেই আমি জিতুর বউ হয়ে গেলাম। আর এখানে আসলে পরে বড়বউ আমাকে হাসিমুখে মেনে না নিলেও মেনে নিয়েছে।  কয়েকদিন পর আবার ঢাকা গিয়ে পড়াশোনাটা শেষ করে নিব।" তখুনি জিতু এসে বাড়িতে ঢুকল, "আরে নিরঞ্জন কাকা যে কি মনে করে?"

নিরঞ্জন কখনোই ভাবে নি জিতু এমন কোনো কাজ করতে পারে। শুধু সে কেন পুরো গ্রামবাসীই তো মনে হয় ভাবতে পারে নি।কিভবেই বা ভাববে জিতু তো কোনোদিক দিয়েই ভাল কোনো ছেলে না এমনকি গ্রামে ছোটখাটো চুরিও করে বেড়িয়েছে।  আর এদিকে সে এমন কান্ড করে বসলো যেখানে বড় বড় শিক্ষিত মানুষরাও কোনো ধর্ষিতা মেয়েকে রাস্তা থেকে তুলে এনে নিজের বউ করার সাহস দেখাতো না। এই অশিক্ষিত মূর্খ ছেলেটা একটা কাজের কাজ করেছে। আনিকার পরিচয় শুনে নিরঞ্জনের মনে হয়েছিলো জিতু অনেক ভাগ্যবান যে আনিকার মতো একটা মেয়ে ওর বউ হয়েছে আর এখন মনে হচ্ছে আনিকা ভাগ্যবতী যে ওই রাতে জিতু ওকে দেখতে পেয়েছিল। এই প্রথম কীর্তনীয়া জিতুর দিকে তাকিয়ে শ্রদ্ধাভরে উত্তর দিল,"এই বৌমার সাথে কথা বলে একটু সময় কাটালাম।" জিতু এসে বসতেই আনিকা ঘরে ঢুকে গেলো। 

কয়েকবছর পর, 
আনিকা পড়াশোনা শেষ করে গ্রামে একটা চেম্বার করেছে প্রত্যেক সপ্তাহে সে চেম্বারে বসে আর গ্রামের মানুষদের বিনা পয়সায় চিকিৎসা করে। সে এখনো জিতুর দ্বিতীয় বউ নামেই পরিচিত।

Author: 
Name: Sarmista Nandi
Studies at Khulna University of Engineering & Technology (KUET)  



STORYLANDBD
STORYLANDBD

This is a short biography of the post author. Maecenas nec odio et ante tincidunt tempus donec vitae sapien ut libero venenatis faucibus nullam quis ante maecenas nec odio et ante tincidunt tempus donec.

No comments:

Post a Comment