কাঞ্চন


       ভাদ্রের শেষ। গত পাচঁ দিন ধরে ঝাপিয়ে  বৃষ্টি যখন আসে, মনে হয় জলের তোড়ে সমস্ত পৃথিবী ছয়লাব হয়ে গেছে। এ পাড়ার গোলপাতায় ছাওয়া ঘরগুলো টুইয়ে বৃষ্টির জল মেঝেতে পড়ে, মাটির মেঝে কাদা করে দেয়। ঘরের পীড়া পৈঠাগুলো অবিরাম বৃষ্টির ছাটে নরম হয়ে আসে, খসে পড়ে।

    শেষ রাত্রির দিকটায় বৃষ্টি থেমে গেছে। আকাশে ধূসর মেঘেদের তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে এলোমেলো হাওয়া। দমকা হাওয়ায় বাড়ির আশেপাশে গাছগুলোর পাতায় জমে থাকা বৃষ্টির জল ঝুপঝাপ পড়ছে।

এত বৃষ্টিতেও ব্যাঙেদের আশ মেটেনি। সোনা ব্যাঙেরাতো সেই মেঘ হবার আগের দিন থেকেই হাকাহাকি শুরু করেছে। এখন এই ক্ষান্তবর্ষণের সময়টুকু যে হালকা এই ক্ষান্তবর্ষণের সময়টুকুতে যে হালকা মেঘগুলো চাঁদের গা শিরশিরিয়ে কোথায় যাবে বুঝে উঠতে পারছে না, সোনা ব্যাঙেরা তাদেরকেও নেমে পড়তে বলছে।  এবার তাদের সঙ্গে নিজেদের বিচিত্র কটকটানি আর লম্বা লম্বা হাত পা নিয়ে সম্মিলিত ডাকাডাকিতে যোগ দিয়েছে গেছোরা, ঘরের কুনেরা। বড় বড় বৃষ্টির ফোটায় ঝিঝিরা উত্যক্ত হয়।  এবার বৃষ্টির ক্ষান্তিতে তারা এমন একটানা ডেকে চলেছে যে সন্দেহ হয় যে ওদের গায়ে গায়ে ঘষাঘষিতে হয়তো আগুন ধরে যাবে।

 ঘরবাড়ি ডুবে যাওয়ায় গর্ত নিবাসীরা অনেকই বেরিয়ে পড়েছে জলে মাটিতে। ব্যাঙ, কাঁকড়ার খোজ বেরিয়েছে শেয়াল, বাঘডাস, খাটাস, সাপেরা আর ব্যাঙের দল উৎসব করে ধরছে পোকামাকড়, কেঁচো, জোঁকদের।

    শেষরাতের বাদুরমথিত দক্ষিনবাঙলার ফ্যাকাসে আকাশ আর মহা পৃথিবীর মধ্যে চলছে, জীবজগতের এক মহা জীবনের উৎসব। মানুষদের মধ্যে খুব অল্প কজন তা দেখতে চেষ্টা করে। যারা দেখে তাদের বলার ক্ষমতা নেই বা বলতে চায় না। শুধু বুকের ভিতর পুষে রেখে একদিন ঘুমিয়ে পড়ে। দাওয়ার দক্ষিনে কোণে দু,দিকে হোগলার বেড়ায় ঘেরা ঘরটিতে ঘুমায় কাঞ্চন। পুবের দক্ষিন আকাশ ফর্সা হতেই ঘুম ভেঙ্গে গেল তার।  গ্রামবাংলার মানুষজন পাখিদের সঙ্গে জেগে ওঠে। মন্থর গতির জীবন প্রবাহে তাদেরকে দিনটি বড় করে নিতে হয়।

    বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ল কাঞ্চন। চোখ ডলতে ডলতে পুকুরে গিয়ে মুখ ধুয়ে নিল। বাড়ি ফিরে দেখল তার বাবা ফরমান গোমস্তা দাওয়ায় বসে একজনের সাথে কথা বলছে। লোকটাকে সে চেনে। রশীদ ঢালি, করাতকলের মালিক সুবেদ মহাজনের ম্যানেজার। ঢালীকে দেখেই তার বুকটা খুশীতে ভরে উঠল। এবার সে জঙ্গলে যাবে। অনেক কষ্টে বাবাকে রাজি করিয়েছে। রান্নাবান্না শিখে নিয়েছে। হাত কুড়ালটা ভালই চালায় তের বছরের শরীরটাও বেশ শক্ত পক্ত হয়ে উঠেছে। 

   দাড়িয়ে থাকার সময় নেই তার গোয়ালঘর হতে গরুদুটোর ঝটপটানি জানান দিচ্ছে তাদের বাইরে আনতে হবে। গোবর, চোনা আর বৃষ্টির জল পড়ে এর মধ্যেই গোয়াল ঘরটি নরক হয়ে উঠেছে। বৃষ্টির দরুন চড়াতে নেয়াই  যায় নি। শুধু ফ্যান আর তরকারির খোসা দিয়ে কি আর  দুটো পেট চালানো যায়? তবে আজ যেন মনে হচ্ছে বৃষ্টিটা সত্যিই ধরবে। 

   কাঞ্চন গরুদুটোকে মাঠে দিয়ে আসল, ঘিনঘিনে গোয়ালটা পরিষ্কার করল, খোয়াড়ের মুরগী ছাড়ল, বর্ষাবর্ধিষ্ণু গজিয়ে ওঠা বিছুটি, কচুর গুচ্ছ কাঁচি দিয়ে ছেটে দিল। এমনকি ছিলে জোঁকঅধ্যুষিত জলপুষ্ট কিছু ঘাসও কেটে আনল।

  গুরুর গুরুর ডাবর হুঁকো চলছে। ছোটবেলা হতে গ্রামের আবু দশটা ছেলের মত কাঞ্চনকেও পিতার জন্য হুঁকো সাজাতে হয়। দা দিয়ে তামাক কাটতে হয়, রোদশুকনো  তামাক চিটাগুড়ে মাখতে হয়। তামাক সাজতে গিয়ে কলকেও টানও তাকে দিতে হয়েছে। আড়াল গিয়ে এভাবে কলকে টানতে গিয়ে একদিন সেও নিজের অলক্ষে তামাক ধরে বসেছে। অবশ্য বাবার সামনে ধরানের সাহস এখনো হয়নি ।

  সুবেদ মহাজন ৪৮ নং লাটে ঘের কিনেছে। সে খান থেকে গাছ কেটে আনতে হবে কাঞ্চনের বাবার। ঢালীর সাথে দরকষাকষীর আলোচনার প্রায় শেষ সময়ে করমান বলল, "ছ'লডারে এবার মুই বাদায় লমু ভাবদে আছি।"
   এই কটি কথা শুনতেই  কাঞ্চন  এতক্ষণ উদগ্রীব হয়ে বসে ছিল। উঠে  দাঁড়াল সে। ফরমান একজোড়া কিশোর চোখে উজ্জল ছবি দেখে খুশি হল। কাঞ্চন আর দাডানো না। ছুটে গেল নদীর উদ্দেশ্য।
              (খসরু চোধুরির 'নতুন বাওয়ালী' সংক্ষিপ্তও পরিবর্তিত) 
                               সংগ্রাহক ও পরিবর্তকঃ রবিন
STORYLANDBD
STORYLANDBD

This is a short biography of the post author. Maecenas nec odio et ante tincidunt tempus donec vitae sapien ut libero venenatis faucibus nullam quis ante maecenas nec odio et ante tincidunt tempus donec.

No comments:

Post a Comment