বাল্যবিবাহ। Early Marriage। Child Marriage



বাল্যবিবাহ

 বিয়ে হল একটি সামাজিক ও ধর্মীয় বন্ধন যার মাধ্যমে দুজন প্রাপ্ত বয়স্ক নারী ও পুরুষের মধ্যে দাম্পত্য সম্পর্ক স্থাপিত হয়। বিয়ে শুধুমাত্র দুজন মানুষের মধ্যে বন্ধন না, বরং এটি দু পরিবারের মধ্যেও বন্ধন। জাতিসংঘের ঘোষণা অনুযায়ি ১৮ বছরের নীচে সকল মানব সন্তানই শিশু। কিন্তু বাংলাদেশের আইন অনুযায়ি মেয়েদের ১৮ বছর আর ছেলেদের ২১ বছরের আগে বিয়ে হলেই তা বাল্য বিবাহ। অর্থাৎ বাল্য বিবাহ হল অপ্রারপ্তবয়স্ক ব্যক্তির আনুষ্ঠানিক অথবা অনানুষ্ঠানিক বিবাহ। বেশিরভাগ বাল্য বিবাহে দুজনের মধ্যে একজন অপ্রাপ্তবয়স্ক হয়ে থাকে। তবে, সাধারণত, মেয়েরাই বাল্য বিবাহের শিকার বেশি হয়। বাল্য বিবাহে মেয়ে এবং ছেলে দুজনের উপরই নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। তবে, মেয়েরাই সাধারণত বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। 


বিভিন্ন কারণেই বাল্য বিবাহের প্রচলন অনেক আগে থেকেই শুরু হয়েছে। এখনও অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশসমূহ যেমন – আফ্রিকার কিছু অংশ, দক্ষিণ এশিয়া, দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া, পশ্চিম এশিয়া, লাতিন আমেরিকা এবং ওশেনিয়া প্রভৃতি দেশে বাল্য বিবাহ বহুল প্রচলিত আছে। নাইজার, চাঁদ, মালি, ভারত, বাংলাদেশ ও আর কিছু দেশে বাল্য বিবাহের হার সবচেয়ে বেশি যা প্রায় ৬০% এরও বেশি। 


সেপ্টেম্বর ২০১৪ এর হিসাব অনুযায়ী ১৫৬ মিলিয়ন ছেলে বাল্য বিবাহের শিকার। মেয়েদের উপর বাল্য বিবাহের প্রভাব দীর্ঘমেয়াদি। পৃথিবীর  সর্বচ্চ বাল্য বিবাহের হার নাইজারে যেখানে প্রতি ৪ জন মেয়ের মধ্যে ৩ জন মেয়ে বাল্য বিবাহের শিকার হয়। 


বাল্যবিবাহের কারণসমূহঃ

ইউএনফপিএর তথ্য অনুযায়ী, যে সকল কারণসমূহ বাল্য বিবাহের জন্য দায়ী তা হল দারিদ্র্য, অর্থনৈতিক অস্থিতিশিলতা, লিঙ্গ- বৈষম্য, যৌতুক প্রথা, পরিবারের সম্মান রক্ষা এবং নিরাপত্তাহীনতা, যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ ও মহামারি ।  



যৌতুক প্রথাঃ

যৌতুক প্রথায় মেয়ের বিয়েতে অভিভাবক সম্পত্তি দান করে যা বেসিরভাগ পরিবারের জন্য অর্থনৈতিক  হুমকি স্বরূপ । যৌতুকের জন্য মেয়ের পরিবারে সম্পদ জমানো ও সংরক্ষণের ক্ষেত্রে প্রবল প্রতিবন্ধিকতা আসে। এ কারনে মেয়ের পরিবার কিছু নগদ অর্থ বা সম্পদ জোগাড় করার সাথে সাথেই মেয়ের বয়স বিবেচনা না করেই বিয়ে দিয়ে দেয়। 

কিছু কিছু দেশে বর বা বরের অভিভাবক কনের পিতাকে পন দিতে হয়।  এক্ষেত্রে কনের বয়স যত কম হয়, তার উপর নির্ধারিত পনের মূল্য তত বেশী হয়। এই রীতির কারণেও মেয়েরা বাল্য বিবাহের শিকার হয়। 


নির্যাতন , জোর পূর্বক দেশান্তর ও দাসত্বঃ 

সামাজিক বিপর্যয় যেমন যুদ্ধ , সামরিক অভিযান, বলপূর্বক  ধর্মান্তর , যুদ্ধবন্ধী করা ও দাসে পরিণত করা, গ্রেপ্তার ও জোরপূর্বক  দেশান্তর করা এসব কারনেও মেয়ের পরিবার যেকোনো পাত্র পেলেই মেয়ের অনিচ্ছাইয় এমনকি মতামত না নিয়েই মেয়ের বিয়ে দিয়ে দেয়। 


ধর্ম ও আইনঃ

যদিও বেসিরভাগ দেশে বিবাহের সর্ব নিম্ন বয়স ১৮ বছর ধরা হয় কিন্তু অনেক দেশের আইনে এর্ ব্যতিক্রম আছে। ২০১৫ সালে স্পেনে বিবাহের সর্বনিম্ন বয়স  পূর্বেকার  ১৪ থেকে ১৬ তে উন্নীত করা হয়। মেক্সিকোতে মেয়ের বিবাহের সর্ব নিম্ন বয়স হল ১৪ ও ছেলেদের ১৬।  যুক্তরাষ্ট্র সহ বেশিরভাগ দেশে আদালতের অনুমতি সাপেক্ষে বাল্য বিবাহের অনুমতি দেয়া হয়। এছাড়াও ধর্ম ও আইন অনুযায়ী নানা দেশে এখনও বাল্য বিবাহের প্রচলন আছে। 


রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক চুক্তিঃ

অনেক সমাজে এখনও বাল্য বিবাহ হয় যাতে দুই পরিবারের মধ্যে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বন্ধন সুদৃঢ় হয়। 


বাল্য বিবাহের প্রভাবঃ 

মেয়ের বিয়ে যে বয়সেই হোক (১৮ এর নীচে হলেও), সামাজিক ও পারিবারিক চাপে নতুন বউ দ্রুত সন্তান নিতে বাধ্য হয়।  কিন্তু একটি মেয়ের শরীর ২০ বছরের আগে সন্তান জন্ম দানের জন্য উপযুক্ত হয় না।  তাই ২০ বছরের আগে সন্তান জন্ম দান একটি  কিশোরী মেয়ের ও তার সন্তানের জীবনের জন্য মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ ।  যদিও বা জন্ম দেয় তা অপুষ্ট, বিকলাঙ্গ বা জন্মগত শারীরিক ও মানসিক ত্রুটি নিয়ে জন্ম নিতে পারে। 


 বাল্য বিবাহ কিশোরী মেয়েদের সহজাত উচ্ছাস, আনন্দ, পরিপক্কতা,উপযুক্ত বেড়ে উঠা ও গতিশীলতা থামিয়ে দেয়।  বাল্য বিবাহের জন্য বিবাহিত কিশোর কিশোরীরা স্কুল ও কলেজ ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। অধিক সন্তান গ্রহনের সুযোগ ও প্রবনতা তৈরি হয়। 

 

বাল্যবিবাহ রোধে বাংলাদেশের পদক্ষেপঃ 

বাংলাদেশ সরকার সম্প্রতি বাল্যবিবাহ রোধে পুরাতন আইনের সংশোধন করেছে। এ আইনে ১৮ বছরের আগে কোন মেয়ের এবং ২১ বছরের আগে কোন ছেলের বিয়ে হতে পারবে না। (বিশেষ কারনে আদালতের অনুমতি নিয়ে হতে পারবে)।  কোন ব্যক্তি বাল্যবিবাহের চুক্তি করলে সেই ব্যক্তি দুই বছর পর্যন্ত বিনাশ্রম কারাদণ্ড বা ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থ বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবে।  

বাল্যবিবাহের সাথে যদি পিতামাতা জড়িত থাকে তবে তারা ৫০ হাজার টাকা জরিমানা দিবে বা দুই বছর পর্যন্ত বিনাশ্রম কারাদণ্ড পাবে। তবে কোন মহিলা দোষী সাব্বস্থ হলে তাকে কারাদণ্ড দেয়া যাবে না। 

এছারাও বাংলাদেশ সরকার বাল্যবিবাহ রোধে সচেতনতামূলক অনেক কর্মসূচী বাস্তবায়ন করছে।  

  


২০১১ সালের ডিসেম্বর মাসে জাতিসংঘের সাধারন অধিবেশনে ১১ই অক্টোবরকে আন্তর্জাতিক কন্যা শিশু দিবস হিসাবে ঘোষণা করা হয়। ১১ই অক্টোবর ২০১২ সালে সর্বপ্রথম আন্তর্জাতিক কন্যা শিশু দিবস পালন করা হয়। যার মূল উদ্দেশ্য ছিল বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ করা। ২০১৩ সালে সর্বপ্রথম জাতিসংঘের  মানবাধিকার সভায় বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে নীতিমালা নির্ধারণ করা হয়।   

বাল্যবিবাহ রোধে বিভিন্ন কর্মসূচী গ্রহন করা হয়েছে। যেমন নারীর ক্ষমতায়ন, সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি বদলানো ও নারী শিক্ষা সমর্থন, বাল্যবিবাহের ঝুকি সম্পর্কে অভিভাবকদের অবহিত করন ইত্যাদি কর্মসূচীর ফলেই বাল্যবিবাহের হার অনেক খানি কমেছে।  


বাল্যবিবাহ একটি সামাজিক ব্যাধি। এটা বন্ধ করতে হলে জাতীয় ভাবে, সামাজিক ভাবে, পারিবারিক ভাবে যৌথ উদ্দগের একান্ত প্রয়োজন। কারও একার পক্ষ্মে এ কঠিন ও গভীর সমস্যা জরিত (deep rooted) ব্যাধিকে হ্রাস করা সম্ভব নয়। আসুন আমরা সবাই মিলে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ করি।  


-সমাপ্তি- 

Author-

Noshin Anjum


STORYLANDBD
STORYLANDBD

This is a short biography of the post author. Maecenas nec odio et ante tincidunt tempus donec vitae sapien ut libero venenatis faucibus nullam quis ante maecenas nec odio et ante tincidunt tempus donec.

No comments:

Post a Comment